‘সৌদি আরবে জঙ্গি সৃষ্টি সিরিয়া সংকটের সূত্রে’

27

সৌদি আরবের যেসব নাগরিক ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছিল, বঞ্চনার কারণে তারা সেখানে যায়নি। বরং সিরিয়াতে সুন্নি বিদ্রোহীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছিল। ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহ আসাদের পক্ষে দাঁড়ালে আসাদ বিরোধী আইএসের পক্ষে যোগ দেয় সৌদি আরবের জঙ্গিরা। এদের বেশিরভাগেরই শিক্ষা-দীক্ষা ছিল। ছিল জীবিকাও। দেশটির সেনাবাহিনী-পুলিশের সদস্য, এমন কি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত যোগ দিয়েছিল ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনে। বঞ্চনা নয়, খিলাফতের ধারণা তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, এই বাস্তবতা ইউরোপ থেকে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া জঙ্গিদের বাস্তবতার চেয়ে ভিন্ন। ইউরোপ থেকে যারা জঙ্গি হয়েছে, তারা মূলত সমাজবিচ্ছিন্ন এবং সুযোগবঞ্চিত শ্রেণি থেকে আগত। তাদের ধর্মীয় জ্ঞানও সৌদি আরবের জঙ্গিদের চেয়ে কম।
৭ ফেব্রæয়ারি ‘কিং ফয়সাল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ’ তাদের এক গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। ইসলামিক স্টেটের ফাঁস হয়ে যাওয়া নথি থেকে তারা তথ্য পেয়েছে ৭৫৯ জন সৌদি নাগরিকের, যারা জঙ্গি সংগঠনটিতে নাম লিখিয়েছিল। এদের তথ্যের ভিত্তিতে ৪০ পৃষ্ঠার গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মূলত ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে সিরিয়াতে ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছিল।
সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য থেকে জানা গিয়েছিল, ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া নিষিদ্ধ করে ২০১৪ সালে আইন পাসের আগে দেশটির প্রায় আড়াই হাজার নাগরিক সিরিয়াতে গিয়েছিল। যেসব জঙ্গির তথ্য পাওয়া গেছে তাদের সংখ্যা এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ। গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০১১ সাল থেকে চলতে থাকা সিরিয়া সংকটের মধ্যে সৌদি আরবের নাগরিকরা দেখতে পেয়েছিল বড় মাত্রার সা¤প্রদায়িক বিভাজন। ২০১৩ সালের মে মাসে ইরান সমর্থিত হেজবুল্লাহ সিরিয়ার আসাদ বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে জড়ায়। অন্যদিকে আসাদের বিরোধীরা মূলত সুন্নি। বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসকে আল সৌদ বলেছেন, ‘এই সময় থেকেই সৌদি আরবের নাগরিকরা সিরিয়া যেতে শুরু করে। আমি মনে করি, সৌদি আরবের জঙ্গিদের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও যুদ্ধ অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়।’
অন্যদিকে ফ্রান্স, বেলজিয়াম এবং যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে যারা সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল তাদের অবস্থা ভিন্ন। ইসলামিক স্টেটের ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রায় তিন হাজার নথি পর্যালোচনা করে এসোসিয়েটেড প্রেস দেখেছে ইউরোপ থেকে ইসলামিক স্টেটে যোগ দেওয়া জঙ্গিরা মূলত সুযোগবঞ্চিত শ্রেণি থেকে আগত।

এদের ৭০ শতাংশের ইসলাম সংক্রান্ত জ্ঞানই আইএসের ফরমে উল্লেখিত অপশনগুলোর মধ্যে একদম নিচের স্তরের। ফলে তাদেরকে খুব সহজেই ইসলামের চরমপন্থী ব্যাখ্যায় উজ্জীবিত করা গেছে।
অন্যদিকে সৌদি আরবের জঙ্গিদের মধ্যে অর্ধেকই বলেছে, তাদের ধর্মীয় জ্ঞান প্রাথমিক পর্যায়ের। আর বাকি অর্ধেকের ধর্মীয় জ্ঞান হয় মোটামুটি, না হয় বিশেষায়িত পর্যায়ের। গবেষকদের মতে, এটাই হওয়ার কথা। কারণ সৌদি আরবের সব শিশুকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় বিষয়ে পড়ানো হয়। গবেষক আব্দুল্লাহ বিন খালেদ আল সৌদ মন্তব্য করেছেন, নতুন প্রজন্মের সৌদি নাগরিকরা বঞ্চনার সূত্রে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে এমন ধারণা সঠিক নয়। যেখানে ইউরোপ থেকে সিরিয়ায় যাওয়া ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের অনেকেই ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, সেখানে সৌদি আরব থেকে সিরিয়ায় যাওয়া সংশ্লিষ্ট ৭৫৯ জন জঙ্গির ৩৪০ জনেরই হাই স্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা ছিল। ৬০ জনের ছিল ডিপ্লোমা ডিগ্রি। পাঁচ জনের ছিল স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। তবে এদের ১৫ শতাংশ ছিল বেকার। সংশ্লিষ্ট জঙ্গিদের যারা বেকার ছিল না তাদের মধ্যে ৫০ জন দেশটির সামরিক বাহিনী, পুলিশ, ধর্মীয় পুলিশ বাহিনী ও মসজিদের ইমাম ছিল। অনেকে নিজেদের ধর্মপ্রচারক হিসেবে পরিচয় দিয়েছিল। সৌদি আরবের জঙ্গিদের মধ্যে ৬২৫ জন যোদ্ধা হতে চেয়েছিল এবং ৭১ জন চেয়েছিল আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী হতে। গবেষক আল সৌদের মতে, এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, জঙ্গিরা খিলাফতের মতো একটি ধারণা বাস্তবায়নে অবদান রাখতে আগ্রহী ছিল, যার ভেতর তারা মৃত্যুর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় জীবনের প্রতিশ্রুতি দেখতে পেয়েছিল।