সোহেল কুটুমের নিয়ন্ত্রণে দেড় হাজার অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ

85

নগরীর বাকলিয়া থানাধীন বাস্তুহারা ও ক্ষেতচর এলাকার প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে একটি চক্র। বাস্তুহারা সমবায় সমিতির ক্রীড়া সম্পাদক সোহেল কুটুম এ চক্রের মূল হোতা বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, সেখানে ১০টি বৈধ লাইন দিয়ে বাকিগুলো সব অবৈধভাবে সংযোগ দেওয়া হয়েছে। আবার বিদ্যুৎ বিভাগের (বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি) একশ্রেণির কর্মচারী ও লাইনম্যান অবৈধ সংযোগ পাইয়ে দেয়ার কাজে সোহেল কুটুমকে সহায়তা করছে।
একই সাথে সোহেল কুটুম গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে ভিন্ন কথা। তারা জানান, আমরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মামলা দিচ্ছি। তারপরও তারা পুনরায় সংযোগ স্থাপন করছে।
গত শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, বাস্তুহারা এলাকায় রয়েছে মসজিদ, মন্দির এবং সৎসঙ্গ বিহার। সেখানে সরকারিভাবে দেয়া হয়েছে বিদ্যুত সংযোগ। তার বাইরে সেখানে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে কয়েকটি প্রি পেইড মিটারের লাইন দেওয়া হলেও ওই এলাকার প্রায় দেড় হাজার পরিবার টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করছে অবৈধ সংযোগ।
এছাড়া ওই এলাকায় কোন ঘর নির্মাণ করার অনুমোদন নেই। কারণ ওই এলাকাটি সরকারি খাস জমির অন্তর্ভুক্ত। তারপরও একটি চক্র সেখানে দখল করা প্লট বিক্রি করছে দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকার মধ্যে। আবার ওই টাকার মধ্যে বাস্তুহারা সমবায় সমিতিকে ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। যার মধ্যে প্লট বিক্রেতা দিবে ১০ হাজার এবং প্লট ক্রেতা দিবে ৫ হাজার। আবার প্রতিমাসে সমিতির চাঁদা বাবদ প্রত্যেক ঘর থেকে নেওয়া হয় ১০০ টাকা করে। এছাড়া দেড় হাজার পরিবার থেকে আদায় করা চাঁদা প্রতিমাসে দাঁড়ায় দেড় লাখ টাকার মত। এই টাকা থেকে বিভিন্ন মহল ভাগ পায় বলে জানা যায়।
চট্টগ্রাম সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, বাস্তুহারা ক্ষেতচরের জায়গাগুলো চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এবং এগুলো উচ্ছেদে পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকায় উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে সেখানে যে অবৈধভাবে প্লট বিকিকিনি হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে, সে বিষয়ে আমি অবগত নই।
বাস্তুহারা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা জায়গাগুলোর জন্য সরকারের কাছে আবেদনপত্র জমা দিয়েছি। যদি সরকার তা গ্রহণ না করে তাহলে যে মুহুর্তে জায়গাগুলো চাইবে আমরা তা বুঝিয়ে দিব সরকারকে। এখানে জায়গা বেচাকেনার যে কথা বলা হচ্ছে, সেটি আসলে ভুল। আমরা আমাদের সদস্যদের কাছে জায়গা আদান-প্রদান করি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা বলেন, এখানে মসজিদ-মন্দির বাদে বৈধ কোন বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। সোহেল কুটুম আমাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য প্রাথমিকভাবে অফেরতযোগ্য ৩০ হাজার টাকা নেন। তারপর লাইন লাগানোর জন্য নেন ৫ হাজার টাকা। প্রতিমাসে একটি বাল্বের জন্য ৩০০ টাকা, ফ্রিজের জন্য ২০০ এবং ফ্যানের জন্য ১০০ টাকা করে আদায় করেন। এছাড়া সোহেল কুটুম বিদ্যুৎ বিভাগের কিছু মাঠ পর্যায়ের কর্মীদেরকে টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেন, যাতে কথাগুলো উপরের মহলে না পৌঁছায়।
তারা আরও জানান, এ অবৈধ সংযোগ দেয়ার অপরাধে সোহেল কুটুমকে ইতিমধ্যে কয়েকবার গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। কিন্তু তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে পুনরায় একই কাজ করেন। আর কেউ তার এ অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীকে ধরে মারধর করেন এবং সবার সামনে লাঞ্ছিত করেন।
বাস্তুহারা এলাকার এক বাসিন্দা জানান, সোহেল কুটুমের নিয়ন্ত্রণে রনি (কিছুদিন আগে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন। বর্তমানে জামিনে মুক্ত), আরমান, বোক্তার, ডন, রাসেল, রবিউলসহ (সোহেল কুটুমের ভাই) ২০-২৫ জন ছেলে রয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে সংযোগ দেওয়া এবং টাকা আদায় করা।
বাস্তুহারা এলাকার আরেক ব্যক্তি বলেন, গত বৃহস্পতিবারে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছে। এ সময় সব বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন ম্যাজিস্ট্রেট। এরপর শনিবার সকালে পুনরায় অবৈধ সংযোগ দেওয়ার জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে নিয়েছেন সোহেল কুটুমের ছেলেরা। এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটকে খবর কেন দিয়েছে বলে মিথ্যা দোষারোপ করে একজনকে মারধর করেন সোহেল কুটুম। ওই সময় বাস্তুহারা সমিতির নেতৃবৃন্দরাও উপস্থিত ছিলেন।
এ নিয়ে জানতে চাইলে অস্বীকার করেন বাস্তুহারা সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, কে কোথায় বিদ্যুৎ সংযোগ দেয় কি দেয় না, সেটি আমি জানি না। আর আমরা বিদ্যুতের মিটারের জন্য আবেদন করার পরও কোন সংযোগ পাইনি। তাই কেউ এদিক ওদিক করে নিচ্ছে হয়তো।
এ ব্যাপারে সোহেল কুটুমের সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে তিনি অস্বীকার করলেও পরে তা স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, আমি বালির ব্যবসা করি। আর বর্তমানে বাস্তুহারা সমবায় সমিতির ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদকের দায়িত্বে আছি, আমি এগুলো করি না।
পরে যখন বেশিরভাগ স্থানীয় ব্যক্তি জানিয়েছে বলে প্রশ্ন করা হয়, তখন তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে অনেকে ষড়যন্ত্র করছে। আমি শুধু আমার আশপাশের দুই তিন ঘরে লাইন দিয়ে প্রতিমাসে দেড়শো টাকা করে নিই।
এটি কি অবৈধ নয়? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, অবৈধ হবে কেন? আমি তো মিটারে টাকা ঢুকাচ্ছি। আর আপনি আমার সাথে দেখা করুন, সামনা সামনি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবো। অথবা আমি কোথায় আসবো বলুন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (বাকলিয়া জোন) শেখ কাউছার মাসুম বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। যদি পুনরায় অবৈধ সংযোগ দেওয়ার খবর পাই, তখন অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন পূর্বদেশকে বলেন, মসজিদ-মন্দিরের জন্য আমি প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছি। একই সাথে কেউ যদি জায়গার বৈধ মালিক হন বা কাগজপত্র দেখাতে পারেন, তাহলে প্রি-পেইড মিটার লাগাতে পারবে। আর কেউ যদি অবৈধ সংযোগ নেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।