সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে বিষাক্ত লবণ আমদানি!

86

৫৮ বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে এবারের মৌসুমে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ। তবে মে মাসের শেষের দিকে উৎপাদন মৌসুম সম্পন্ন হলেও এখনো অবিক্রিত অবস্থায় আছে লাখ লাখ টন লবণ।
অভিযোগ উঠেছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা শিল্প লবণের আড়ালে দেদারছে সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত লবণ এনে ভোজ্য হিসেবে বাজারজাত করায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
গত শুক্রবার কক্সবাজার শহরের একটি অভিজাত হোটেলের হলরুমে আয়োজিত ‘লবণ চাষ ও অয়োডিনযুক্তকরণ: সর্বজনীন আয়োডিনযুক্ত’ শীর্ষক কর্মশালায় এসব অভিযোগ তুলে ধরেন মিল মালিক ও সংশ্লিষ্ট চাষিরা। এ সময় এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, লবণ বোর্ড গঠন, সরকারিভাবে পলিথিন সরবরাহ ও আর্থিক সহায়তা দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন তারা। খবর বাংলানিউজের
কর্মশালায় জানা যায়, ২০১৭ সালে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৫ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিক টন। আর উৎপাদন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ মেট্রিক টন। এই হিসাবে চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু সেই বছর আমদানি করা হয় ৫ লাখ মেট্রিক টন।
আমদানি বাদে ২ লাখ ৮৮ মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত থাকে। ২০১৮ সালে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন লবণ। এতে ঘাটতি থাকে ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০১৭ সালের উদ্বৃত্ত ২ লাখ ৮৮ মেট্রিক টন বাদে চাহিদার তুলনায় ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উদ্বৃত্ত ছিল। আর গত ২৪ মে সম্পন্ন হওয়া মৌসুমে দেশের ৫৮ বছরের রেকর্ড ভেঙে এবার লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। যা ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
কিন্তু মিল মালিকেরা বলছেন, উৎপাদনে ৫৮ বছরের রেকর্ড ভাঙলেও চাষি এবং মিল মালিকেরা এর কোনো ধরনের সুফল ভোগ করতে পারছেন না। বরং সেটিই যেন কাল হয়েছে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকার চাষিদের।
গত মে মাসের শেষদিকে উৎপাদন মৌসুম সম্পন্ন হলেও অবিক্রিত অবস্থায় এখনো মাঠে পড়ে আছে লাখ লাখ টন লবণ। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ শিল্পের আড়ালে দেদারছে সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত লবণ এনে ভোজ্য হিসেবে বাজারজাত করায় এখানকার চাষিদের এমন দশা দেখা দিয়েছে।
তারা অভিযোগ করেন, ২০১৭-২০১৮ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন উদ্বৃত্ত থাকলেও কালোবাজারিদের মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে ঢুকে পড়ে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন লবণ। সেই সঙ্গে শিল্পের আড়ালেও দেশে ঢুকে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন সোডিয়াম সালফেট মিশ্রিত বিষাক্ত লবণ। এসব বিষাক্ত ভোজ্য লবণ হিসেবেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে। ইতোমধ্যে কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই ধরনের বিষাক্ত লবণ জব্দ করা হয়েছে।
জানা গেছে, সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে সূর্যের তাপে শুকিয়ে দেশে এর উৎপাদন প্রচলন হয় ১৯৬০ সালের শেষদিকে। বর্তমানে কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলারসহ (আংশিক) ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমিতে ৫৫ হাজারের বেশি চাষি লবণ চাষ করেন। কিন্তু দালাল, ফঁড়িয়া ও আমাদনির চক্রের কারণে এসব চাষিরা বারবার ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বশে এনে লবণ আমদানি করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ও দাম কম হওয়ায় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত সোডিয়াম সালফেট আমদানি করে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ভোজ্য লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) হিসেবে বাজারে ছাড়চ্ছে বলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষায় স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য ও শিল্পের (সোডিয়াম সালফেট) দর দেশের বাজারের ভোজ্য লবণের চেয়ে অনেক কম। ভোজ্য আমদানি-নিষিদ্ধ হওয়ায় শিল্প লবণের আমদানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। চাহিদার দ্বিগুণের বেশি আমদানি হওয়া শিল্প খোলা বাজারে ভোজ্য লবণ হিসেবে বিক্রি হচ্ছে।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারদর অপেক্ষা স্থানীয় বাজারে অপরিশোধিত লবণের মূল্য বেশি হওয়ায় ওই বাজার থেকে সোডিয়াম সালফেটের নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি হচ্ছে। এতে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে অপরিশোধিত লবণের অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য উৎসাহিত হচ্ছে। স্থানীয় অসাধু ব্যবসায়ীরা সোডিয়াম ক্লোরাইডের সঙ্গে সোডিয়াম সালফেট মিশিয়ে বাজারজাত করার ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) হিসাব অনুযায়ী, দেশে ভোজ্য ও শিল্প লবণের বার্ষিক চাহিদা ১৬ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি। কিন্তু গত অর্থবছর দেশে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৭৫৮ টন লবণ আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইড ৮ লাখ ৯০ হাজার ১৮০ টন, হোয়াইট সোডিয়াম সালফেট ৫ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ টন ও সোডিয়াম সালফেটস ২৬ হাজার ৫৩০ টন আমদানি হয়েছে।
আমদানি-নিষিদ্ধ খাওয়ার ওপর মোট ৯৩ শতাংশ শুল্ককর এবং শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের লবণ আমদানিতে ৩৭ শতাংশ শুল্ককর আরোপিত আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত খাওয়ার লবণের দাম এতোই কম যে, এই হারে শুল্ক পরিশোধের পরও প্রতিকেজিতে আমদানি খরচ হয় ৫ টাকা ৬৯ পয়সা। আর দেশে উৎপাদিত অপরিশোধিত এর প্রতিকেজির মূল্য ৬ টাকা ৫ পয়সা। ফলে শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আমদানি করে তা খাওয়ার লবণ হিসেবে বাজারে ছাড়চ্ছে।
চৌফলদন্ডির চাষি আবদুর রহমান ও খুটাখালীর সৈয়দ আহমদ বলেন, মাঠপর্যায়ে সাদা লবণের দাম এখন প্রতি বস্তা (প্রতিবস্তা ৭৪-৭৫ কেজি ওজনের) ২৩০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। আর আয়োডিন মেশানোর পর তা মিল মালিকরা বিক্রি করছেন ৬৪০ টাকা থেকে ৬৭০ টাকায়। অন্যবছরের মতো দেশের সরকারি-বেসরকারি কোম্পানিগুলো এখন আর লবণ কিনছে না। ফলে মাঠে এখনো লাখ লাখ টন পড়ে আছে লবণ।
ইসলামপুরের মিল মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি সামশুল আলম আজাদ বলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষিরা এর উৎপাদন করলেও তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। তাই এ শিল্পের উন্নয়নে প্রান্তিক চাষিদের দিকে সরকারের আরও বেশি নজর বাড়াতে হবে। এছাড়া লবণ বোর্ড গঠন, চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়, মধ্যস্বত্বভোগীদের হয়রানি থেকে বাঁচতে তাদের সরকারিভাবে পলিথিন সরবরাহ ও আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) লবণ কেন্দ্রের উপ-মহা ব্যবস্থাপক সৈয়দ আহমদ বলেন, এই শিল্পের আড়ালে আমদানি করা লবণে দেশ সয়লাব। অথচ দেশে উৎপাদিত লবণই শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। দেশে দুই ধরনের লবণের আমদানির কোনো প্রয়োজন নেই।
তবে কর্মশালায় শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বলেছেন, আমদানি নির্ভরশীল না হয়ে দেশে গুণগত মানসম্মত লবণের লক্ষে মন্ত্রণালয়ের আওতায় বিসিকের মাধ্যমে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউনিসেফের সহায়তায় লবণ চাষের নতুন প্রযুক্তি পাইলটিং কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি চাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে দেশে অধিক পরিমাণ গুণগত মানসম্মত লবণ উৎপাদন সম্ভব হবে।