সৈয়দ আলী আহসান

4

সৈয়দ আলী আহসান, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক। ১৯২০ সালের ২৬ মার্চ মাগুরা জেলার আলোকদিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আলী হামেদ ছিলেন একজন স্কুল ইন্সপেক্টর; মাতা সৈয়দা কামরুন্নেগার খাতুন ছিলেন ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা গ্রামের জমিদার ও পীর সৈয়দ মোকাররম আলীর কন্যা। পিতৃমাতৃকুল দুদিক থেকেই তিনি ছিলেন সুফি ঐতিহ্যে লালিত।
১৯৩৭ সালে আর্মানীটোলা স্কুলে অধ্যয়নকালে স্কুল ম্যাগাজিনে সৈয়দ আলী আহসানের ‘ঞযব জড়ংব’ নামে একটি ইংরেজি কবিতা প্রকাশিত হয়। পরে আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী, সওগাত পত্রিকায় বাংলা ভাষায় তাঁর গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকাকালে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত ত্রৈমাসিক পরিচয় পত্রিকায় তাঁর ‘কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ সময়ে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে এর সম্পাদক এবং জ্ঞাতিভ্রাতা সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন সভাপতি হন। তাঁরা কতিপয় নব্য শিক্ষিত তরুণদের সহায়তায় পাকিস্তান রাষ্ট্রগঠন সমর্থন করেন এবং টিএস ইলিয়ট ও আইরিশ রিভাইভালের চিন্তাধারা, বাংলা পুঁথিসাহিত্য ও মুসলিম ঐতিহ্যের সমন্বয়ে এক বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে সৈয়দ আলী আহসান কিছুদিন কলেজে অধ্যাপনা করেন এবং ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কলকাতা কেন্দ্রে সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠান প্রযোজনার কাজে যোগ দেন। এই সময় থেকে তিনি দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। নিজেও কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি ইলিয়ট ও ইকবালের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ করেন; একদিকে ইসলামি ভাব ও বিষয় নিয়ে, অন্যদিকে লেনিন ও অন্য সামাজিক প্রসঙ্গ নিয়ে কবিতা রচনা করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে তিনি অধ্যাপনায় যোগ দেন।
১৯৫৪ সালে তিনি করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার রিডার ও বিভাগীয় প্রধানরূপে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত একটি ইংরেজি ষাণ্মাষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। বছর কয়েক পূর্ব থেকে তিনি আন্তর্জাতিক লেখক সংঘ ‘পি ই এন’ এবং ‘কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম’ শীর্ষক দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি এ সূত্রে পরবর্তী কয়েক বছরে ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় দেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন তাঁর নেতৃত্বে বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হয়। একাডেমীর এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অনেক কবি-সাহিত্যিক সংগঠিত করতে সক্ষম হন।
১৯৬৭ সালে তিনি নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং কলা অনুষদের ডীন নিযুক্ত হন। তিন বছরের অধিক সময় চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিক্ষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত বহু কর্মসূচিতে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি ভারতে চলে যান এবং কলকাতায় অবস্থান করে যুদ্ধের পুরো নয় মাস স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেন। তিনি লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে স্থানীয় ও বিশ্ব জনমত গৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭২ সালে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। নবনির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আধুনিক ও পূর্ণাঙ্গরূপে গড়ে তোলা ছড়াও বহু গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেন। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সংবিধানের বাংলা ভাষ্য চূড়ান্তকরণ, শিল্পকলা একাডেমীর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন, বাংলা একাডেমী ও বাংলা ডেভেলপমেন্ট বোর্ড একত্রীকরণ, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা কমিশন ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের ইংরেজি অনুবাদ তিনিই সম্পন্ন করেন।
১৯৭৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগদান করেন। ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও ধর্ম সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের ২৪ জুলাই তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপকরূপে যোগদান করেন। ১৯৮০ সাল থেকে কিছুকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে খন্ডকালীন শিক্ষকরূপে বক্তৃতা দেন ও গবেষণাকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি অঢ়ঢ়ৎড়ধপয শীর্ষক একটি ইংরেজি ষাণ্মসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে ‘বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করে ঢাকায় ২টি এশীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করেন। ১৯৮৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল থেকে প্রায় দুবছর তিনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল ইহসানের উপাচার্যরূপে কর্মরত ছিলেন।
২০০২ সালের ২৫ জুলাই তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সূত্র : বাংলাপিডিয়া