সে প্রতিক্রিয়াশীল, আর তুমি খুনি!

111

তৃতীয় বিশ্বের আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘স্যোশাল মিডিয়া’। আর এই ‘স্যোশাল মিডিয়া’ বা ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম’ আজ এতোটাই শক্তিশালী, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির চিন্তা, দর্শন, স্বপ্ন, কর্মদক্ষতার প্রতিচিত্র দৃশ্যমান। আবার নিবিরভাবে পর্যালোচনা করলেও বোঝা যায়, একটি মানুষ ‘প্রগতিশীল’ চিন্তার দর্শন নিয়ে জীবন-যাপন করছে, নাকি ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ভাবধারায় অপরকে আঘাত করছে, করবে। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে পুরো বিশ্ব নানানভাবে গবেষণা করছে। অভিযোগ আছে, ডোনাল ট্রাম্পও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করে ব্যক্তির বয়স, মন-মানসিকতা, চিন্তা-চেতনা আর চাওয়া-পাওয়া বা পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো গবেষণা করে প্রতিটি ব্যক্তির ধরণ অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন বার্তা তৈরি করে সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওইসব ব্যবহারকারীদের কাছে পাঠিয়ে নির্বাচনে নিজের পক্ষে আকৃষ্ট করেছে, ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করেছে।
আবার সাইবার ক্রাইম নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর সাইট বা অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করেই বলতে পারে, ওই ব্যক্তি অপরাধ জগতের মানুষ কিনা কিংবা কোনও অপরাধের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে কিনা। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ নেটওয়ার্কের সাথে কোন জঙ্গির কতটুকু সম্পৃক্ত-এটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো পর্যালোচনার কিংবা গবেষণার মাধ্যমে বের করা সম্ভব।
যেমন বাঁশেরকেল্লা। বাঁশেরকেল্লার সাইট ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী’ জামায়াত-শিবির দ্বারা পরিচালিত। বাংলাদেশ থেকে এই সাইট বন্ধ করলেও মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশ থেকে এটিকে আবার সক্রিয় করা হয়। আবার এই বাঁশেরকেল্লার সাথে সম্পৃক্ত বা বাঁশেরকেল্লা সাইট যারা পছন্দ করে, তাদের ৯৯ ভাগ ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বা ‘উগ্রপন্থী’-এটি আমি কাজ করার সুবাধে জেনেছি। বাঁশেরকেল্লাকে পছন্দ করেন-এমন অনেকের সাথে কথা বলেও প্রমাণ পেয়েছি। আর এই বাঁশেরকেল্লা থেকেই প্রথমে রাজাকার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদের বুকে দেখা গিয়েছে বলে মিথ্যাচার-অপপ্রচার চালিয়েছে। সাথে-সাথে প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তি ও মহল তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী সারা বাংলাদেশে তাÐব চালিয়েছে। বাংলাদেশে যত গুজব বা মিথ্যাচার অতীতে হয়েছে, তার উল্লেখযোগ্য প্রায় সব কয়টি এই বাঁশেরকেল্লা থেকেই হয়েছে।
এখানে উপরের কথাগুলো বলেছি এই কারণে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আজ প্রতিটি ব্যবহারকারীর চারিত্রিক প্রত্যয়নপত্র হয়ে একটি মানুষকে চিনিয়ে দিতে, তার ব্যাপারে তথ্য জানাতে সহায়তা করে আসছে। আমাদের বøগারদের কাছে খুব পরিচিত বচন, ‘লেঞ্জা ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড’! অর্থাৎ, আপনার স্বভাবজাত লুকানো সত্যিই কঠিন। যেমন, একশ্রেণির মানুষ হাজার চেষ্টা করেও তার আঞ্চলিকতা বা আঞ্চলিকভাষা লুকাতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে ‘প্রগতিশীল’ বা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ব্যক্তিরাও তাঁদের স্বভাবজাত ‘প্রতিক্রিয়া’ বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারে না।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চের পরে অনেক বøগার ‘আমি বøগার’-এই শব্দটি সবার কাছে বলে বেড়াত না। আমি বøগার বলে আত্ম পরিচয় তুলে ধরত না কারণ, সত্যিকারের বøগারের পরিচয় তার বøগ সাইটে, তাঁর লেখায়। তবে, ‘আমি বøগার’-এই কথাটি বলার লোকের সংখ্যাও তখন কম ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন করলে হেফাজতের কর্মীর মতন বলতে শুনেছি, ‘বøগ দিয়ে ইন্টারনেট চালায়! বøগ মানে ই-য়ে, আমিও শাহবাগে দাঁড়িয়েছি’। আর বøগারদের যখন স্বাধীনবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী নাস্তিক ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে, যখন পরিকল্পিতভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে বøগার হত্যার মহাউৎসবে মেতে উঠেছিল; তখন সুবিধা নেওয়া বা বøগ দিয়ে ইন্টারনেট চালায় বলার লোকগুলোকে আর দেখা যায়নি। তারা বøগার-এই কথাটিও আর বলেনি, মাঠে-ঘাটে শোনা যায়নি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যখন টানা দ্বিতীয়বারের মতন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে, ঠিক তার পরবর্তী সময়গুলোতে সবাই কেমন জানি আওয়ামী লীগ হয়ে গেল। বলা যেতে পারে, একপ্রকার হঠাৎ করেই যেন পুরো বাংলাদেশই ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ হয়ে গেল। এতো এতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক চারপাশে, হাটতে গেলেও শরীরের সাথে ধাক্কা লেগে যেত। আমি ‘সরি’ বলার পরেও আমাকেই জামাত-শিবির বানিয়ে দিত। পারলে আমাকেই যেন পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়, শরীরে আঘাত করে। সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে আরম্ভ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমার নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত আমার দারোয়ান ভাইটিও বড় আওয়ামী লীগার। ফুটপাতে বাইসাইকেল উঠিয়ে দেওয়া আমার ছেলের বয়সী ছেলেটিও হুঙ্কার দিয়ে বলে, দেখেন না, ছাত্রলীগ লেখা…, আসলেও বাইসাইকেলের সামনে-পিছে তাই লেখা। যেমন লেখা- সাংবাদিকলীগ, ভাইলীগ, পুলিশলীগ, সরকারীলীগ, শিক্ষকলীগ, বুদ্ধিজীবীলীগ, ডাক্তারলীগ ইত্যাদি-ইত্যাদি।
আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা টানা তৃতীয়বারের মতন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দেখা যাচ্ছে, পুরো পৃথিবী যেন আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ।
এখানেও কথাগুলো এভাবে তুলে ধরেছি এই কারণে, কে আওয়ামী লীগ আর কে আওয়ামী বিরোধী আবার কে দেশপ্রেমিক আর কে স্বাধীনতাবিরোধী-এটি প্রতিটি মানুষের কর্মকাÐের মাঝেই প্রতীয়মান। আর যারা স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তাদের প্রতিটি কর্মকাÐ আর চিন্তা-দর্শনের প্রত্যয়ন পত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার ঘটনা নিয়ে একদল আবরারকে জামাত-শিবিরের লোক বলে দাবি করছে, আবার আরেকদল বলছে- আবরার ফাহাদ আওয়ামীগার! অন্যদিকে আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহও বলেছেন, তাঁর পুরো পরিবার আওয়ামীগার এবং তাদের এলাকার আওয়ামী লীগের যত নেতাকর্মী আছে, সবাইকে জিজ্ঞেসে করলে এটাই বলবে যে, এই বাড়িতে যেতে হবে না, তারা সবাই আওয়ামীগার, আওয়ামী লীগকে ভোট দিবে।
পাঠক বন্ধুদের নিশ্চয় মনে আছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে পরিচিত গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার কথা! ওই হামলায় অংশ নেওয়া হামলাকারীদের একজন নিবরাস ইসলাম। পড়ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিবরাসও আর ১০ জন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের মতোই হাসতে, মজা করতে ভালোবাসতো। ফুটবল পাগল ছিল সে। কিন্তু হঠাৎ বদলে যায় নিবরাস। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ভোর ৩টা ১৯ মিনিটে টুইট বার্তায় নিবরাস লেখে, ‘চিরবিদায়।’ আর মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় নিবরাস যে ভিতরে-ভিতরে পুরোদস্তুর একজন জঙ্গি-এটা হলি আর্টিজান হামলার আগে কেউ কি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেছে? কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিবরাসের জঙ্গি হওয়ার প্রত্যয় পত্র পাওয়া গেছে। স্যোশাল মিডিয়ায় নিবরাস তার সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া এবং হত্যাশার কথা ব্যক্ত করেছে। অন্যান্য জঙ্গিদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগসূত্রগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রমাণ পেয়েছে।
এখন কথা হচ্ছে, বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু স্ক্রিনশট ভাইরাল করেছে কতিপয় গ্রহণযোগ্য অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও সাইবার গবেষক। সেসাথে আবরার ফাহাদের ভাই আবরার ফাইয়াজের স্যোশাল মিডিয়ার কিছু স্ক্রিনশটও যুক্ত করে অনেকে স্ট্যাটাস দিয়েছে, আবরার ফাইয়াজ ‘জঙ্গি’ না হলে তার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভ কেন? অনেকে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণও করেছে। আবার আমিও জানার চেষ্টায় নিজেও বিস্তারিত খোঁজ-খবর নিয়েছি। তার রিমেম্বারিং ফেসবুকে গিয়ে খুব বেশি জানা সম্ভব হয়নি। আর রিমেম্বারিং করার কারণে গত বছর বা তার আগের স্ট্যাটাসগুলোও দেখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, একটি ক্লিয়ার ভিডিও ফুটেজ মূল গণমাধ্যমেরও আগেই স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রচার সেল বাঁশেরকেল্লায় সর্বপ্রথম ভাইরাল করা হয়।
আরেকটি ভয়ঙ্কর তথ্য ভাইরাল হয়েছে আবরার ফাহাদ হত্যাকাÐে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ওইসব ছাত্রলীগের কর্মীরা এককালে ছাত্রশিবিরও করেছে যার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রত্যয়ন পত্রও ভাইরাল করেছে। কার বাবা কী ছিলো, কোন রাজনৈতিক আদর্শের মানুষ ছিলো, বাবা কবেকার আওয়ামীগার আর ছেলেকে কবেকার ছাত্রলীগেরকর্মী বানিয়েছে, তারও পূর্ণবিবরণ তুলে ধরেছে।
তবে, ছাত্রলীগে শিবিরকরণ-এই অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি নাটোরের সিংড়া পৌর জামায়াতে ইসলামীর আমির রওশন আলীর ছেলে খালিদ হাসানকে যখন ওই উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়, ফ্রিডম পার্টির নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে যখন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়, যুবলীগের কর্মী না হয়েও জিকে শামীম যখন যুবলীগের সম্পাদক পরিচয়ে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়; তখন ভাইরাল হওয়া তথ্য উপাত্তের পক্ষেই প্রমাণ প্রতীয়মান হয়।
আর ছাত্রশিবির থেকে ছাত্রলীগ, ফ্রিডম পার্টি থেকে যুবলীগ করা নেতাকর্মীদের কাছ থেকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধু আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ এবং শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দর্শন আশা করতে পারি না। আর এই তারাই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ভিতরে ভিতরে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করবে। এই তারাই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে শেখ হাসিনার কর্মযজ্ঞকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবে। সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে অনৈতিক কর্মকাÐসহ টুনকো বিষয় নিয়ে মানুষকে হত্যা করবে।
তাহলে আবরার ফাহাদ প্রতিক্রিয়াশীল বা জামায়াত-শিবির হলে, তুমি তো খুনি! এই খুন করার বৈধতা তোমাকে বা তোমাদের কে কখন দিয়েছে? একটা মানুষ অমানুষ হলে, জঙ্গি-শিবির হলে রাষ্ট্র তার দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়েছে। তাকে ভালোর পথে, আলোর জগতে ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করবে। পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রাণীরও বাঁচার অধিকার আছে। আর সেখানে একটা ছেলেকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পিটিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে তুমি ও তোমরা কোন সভ্যতার অংশীদার হলে এখন?
ছাত্ররাজনীতির সাথে যারা জড়িত, যারা ছাত্রদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য রাজনীতি করে-এ দায় তাদের। একটা ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ছাত্রকে ‘প্রগতিশীল’ করতে না পারা, ভ্রান্ত পথ থেকে আলোর পথ দেখানোর ব্যর্থতা, ছাত্রনেতারা ছাত্রদের কাছে বিশ্বস্ত বন্ধু হতে না পারাও ছাত্রনেতা হওয়ার অযোগ্যতা। আর কেউ ভুল তথ্য ভাইরাল করলে তার শাস্তি শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা নয় বরং ওই মিথ্যা তথ্যের সামনে সত্য তুলে ধরাই প্রকৃত যোদ্ধার ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের কাজ।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট