সেন্টমার্টিনে সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃত্যু বাড়ছেই

145

প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলছেই। পাশাপাশি নির্বিচারে মাছধরার চর্চার শিকার হয়ে নানা প্রজাতির হাঙরের অপমৃত্যু তো আছেই। গত এক সপ্তাহে ৮ টির বেশি কচ্ছপ ও ডলফিন মারা গেছে এই প্রবাল দ্বীপে। সেগুলো ইতোমধ্যে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেন্টমার্টিনের পরিবেশ অধিদপ্তর ও বীচ ম্যানেজম্যান্ট কর্মীরা। তাদের মতে, এর আগে গত এক বছরে আরও ১০টি বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিন মারা পড়ে দ্বীপে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও বীচ কর্মীরা জানায়, সর্বশেষ গত সোমবার সকালে সেন্টমার্টিনের সৈকতের দক্ষিণ পাড়ায় ১টি মৃত কচ্ছপ ও পশ্চিম পাড়ায় ১টি মৃত ডলফিন ভেসে আসে। এর আগে ২৩ ও ২২ ফেব্রæয়ারি জেটির দক্ষিণ পাশে পশ্চিম সৈকতে ও উত্তর সৈকতে (কবরস্থানের পাশে) কচ্ছপ ও ডলফিনের আরও দু’টি মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। সাধারণত দ্বীপের উত্তর, উত্তর-পশ্চিম, পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ দিকে থাকা প্রবালসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে জেলেদের জাল ফেলা হয়। এসব জালে আটকে অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে কচ্ছপও মারা পড়ে। এ এলাকায় প্রচুর সামুদ্রিক ঘাস ও সিউইডের মতো শৈবাল থাকায় এটি কচ্ছপের খাবার-দাবারের জন্য বেশ ভালো জায়গা। তা ছাড়া ডিম পাড়ার জন্যও এ এলাকা পার হয়ে আসতে হয় কচ্ছপদের। তাছাড়া প্রতিবছর শীত মৌসুমে প্রজনন মৌসুমে (ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত) কচ্ছপরা সৈকতে ডিম ছাড়তে আসার সময় জালে আটকা পড়েঅনেক মা কচ্ছপ মারা যাচ্ছে।
দ্বীপে ভ্রমণকারী কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রণমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘আমি দ্বীপে ভ্রমণে এসে আজ (মঙ্গলবার) সকালে সৈকতে মৃত ডলফিন পড়ে থাকতে দেখেছি। গত কয়েকদিন ধরে কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে আসার খবর সেখানকার লোকজনের মুখে মুখে’। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আদালতের সুষ্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্তে¡ও সেন্টমার্টিনে কোনো নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। সরকার ‘পরিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা’র আওতায় রেখেছে; কিন্তু জনবল নেই পর্যাপ্ত, তহবিল নেই, পরিবেশ অধিদফতর খুব সামান্যই ভূমিকা রাখতে পারছে। এইভাবে চলতে থাকলে বিশ্বখ্যাত এই প্রবাল দ্বীপ চিরতরে হারিয়ে যাবে’।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেন্টমার্টিন সাগরে ১০৩টি প্রজাতির অনেকগুলোই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পর্যটকের অবাধ চলাচলের কারণে কাঁকড়ার প্রজনন কমে গেছে। অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন এবং যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে পানি ও মাটিদূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে প্রবাল আহরণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সেটি অমান্য করে প্রবাল আহরণ চলছেই। দ্বীপে পরিবেশ রক্ষায় ৬ জন বীচ কর্মী এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ১৭ জন লোকবল থাকলেও বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃত সংখ্যা বাড়ছে।
দ্বীপের জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য মতে, দ্বীপের গলাচিপা গ্রামে ২০০৬ সালে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং গবেষণার জন্য ১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মেরিন পার্ক বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তর। চারদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে আবদ্ধ পার্কের সাইনবোর্ডে লেখা ‘সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ কার্যক্রম (পর্যবেক্ষণ ও হ্যাচারি)’। ভেতরে গিয়ে দেখা যায় কাছিম ভরে রাখার বহু ঝুড়িও, নেই শুধু কাছিম। ২০১০ সাল পর্যন্ত পার্কটির যথেষ্ট তদারকিও থাকলেও এখন করুণ দশা।
জানতে চাইলে সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন,‘দ্বীপে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সৈকতে সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিনের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এইভাবে চলতে থাকলে সামুদ্রিক কচ্ছপ ও ডলফিন বাঁচানো যাবে না। তাই দ্বীপ নিয়ে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া খুবই দরকার’।
দ্বীপে দায়িত্বরত পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মী আবদুল আজিজ বলেন, ‘সৈকতে ভেসে আসা মৃত কচ্ছপ ও ডলফিনের মরদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। দ্বীপে এমন পরিবেশ বিধ্বংসী পর্যটন গড়ে উঠেছে, নানা কৃত্রিম কাঠামো, অনেক বেশি আলো, ডিজেল জেনারেটরের শব্দ ও লাউড স্পিকারের কান ফাটানো আওয়াজে ডিম পাড়তে আসা কচ্ছপের পরিমাণ কমে যাচ্ছে’। তিনি বলেন, ‘অনেক হোটেল মালিক নিজেদের সুবিধার জন্য সাগর থেকে পাথর তুলে এনে নিচু দেয়ালের মতো গড়ছে সৈকতে, যার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কচ্ছপরা’।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অবৈধ কারেন্ট জালে আটকা পড়েই অধিকাংশ মা কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে। নিষিদ্ধ জাল উচ্ছেদ অভিযান আরও জোরদার করা হবে’।
এ প্রসঙ্গে সদ্য যোগদানকারী পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষায় গত কয়েকদিন আগেও দ্বীপে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। আমরা দ্বীপ বাঁচাতে সাধ্যমত চেষ্টা করছি। তবে জেলেদের কারণে কচ্ছপ ও ডলফিন মারা পড়ছে। বিপন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক এসব প্রাণী রক্ষায় নতুন করে কাজ শুরু করা হবে’।