সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের মধ্যে এত হানাহানি, যুদ্ধ বিগ্রহ কেন?

370

মানুষের রয়েছে কতকগুলো গুণ, যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। চেহারা সৌন্দয্য, ভাষার ব্যবহার, জ্ঞান, বুদ্ধি। মনুষ্যত্ব মানবিকতা, নীতি নৈতিকতা, ধর্মকর্ম ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত মানুষ যেমন শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার, তেমনি লোভ লালসা কামনা বাসনা, হিংসা বিদ্বেষ, গর্ব অহংকার, জেদ ক্রোধ ইত্যাদি কুপ্রবৃত্তিগুলোকে চরিতার্থ করতে গিয়ে মনুষ্যত্বের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলেছে। মানুষের প্রয়োজনে মানুষ না হয়ে মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে মানুষের শত্রæ। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ হজরত হাওয়া আ. কে সৃষ্টি করেছিলেন হজরত আদম সা. এর প্রয়োজনে সঙ্গী বা সাথীরূপে এবং সহায়তাকারী হিসেবে। অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে গধহ ঈধহহড়ঃ খরাব ধষড়হব, অর্থাৎ মানুষ একাকী বসবাস করতে পারে না। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণসহ নানা কাজে তাকে সামাজিকভাবে বসবাস করতে হয়। অন্যান্য প্রাণী মানুষ থেকে ব্যতিক্রম, শুধু কথা বলায় নয়, বেড়ে ওঠায়, চলাফেরায়, জ্ঞানে বুদ্ধিতে, চাতুরতায় এবং পারস্পরিক সহযোগিতায়, ভূমিষ্ট হওয়ার পর মানুষ চলতে না পারলেও অন্যান্য প্রাণী তা পারে। জন্মের পরে অনেকটা দিন তাকে অসহায় অবস্থায় কাটাতে হয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা মানুষের নিত্য সঙ্গী। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে কোনো না কোনোভাবে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। বলা চলে-নির্ভরশীলতাই জীবন। তবে এ নির্ভরশীলতা মানুষকে ছোট করেনি, বরং মানুষের জীবনের প্রয়োজন পূর্ণ করেছে। মানুষকে দিয়েছে সামাজিকতা, সুন্দর বসবাসের নিশ্চয়তা, সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি, ভালবাসার নিবিড়তায় পৃথিবীটা মানুষের জন্য হয়ে উঠেছে স্বর্গভূমি।
যুগে যুগে মানুষই মানুষের জন্য তথা অনাগত প্রজন্মের জন্য এই পৃথিবীটাকে গড়েছে। মানুষই মানুষের প্রকৃত বন্ধু, স্থায়ী, সহযোগী, এর বিপরীতও, পটি মনুষ্যবৈশিষ্ট বর্জিত। কাম্য না হলেও অনিবার্য, মানুষ মানুষের সহযোগিতার বদলে কখনও হয়ে উঠেছে শত্রæ হয়ে। চিন্তা করেছে বুদ্ধি এটেছে কিভাবে স্বজাতিকে ধ্বংস করা যায়। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা বিবর্জিত এ শ্রেণীকে কী মানুষ বলা যায়? পশু নিজের স্বজাতিকে ধ্বংসের মতো ঘৃণ্য কাজটি কখনো করে না। অতএব মানুষরূপ ওই শ্রেণীটিকে পশু বললেও মনে হয় কম বলা হবে।
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে মানুষের প্রতি কেন এত অন্যায়? কেন এত অবিচার। মানুষে মানুষে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ইত্যাদি পার্থক্যগত চিন্তা আমাদেরকে নিজেদের জন্য চিন্তা করতে শিখিয়েছে সত্য, কিন্তু সেখানে বিরোধ কেন? আর পার্থক্য ভুলে সকলের জন্য করলে ক্ষতি কোথায়? জগতের বড় বড় কবি সাহিত্যিক ও বিশিষ্টজনেরা কখনো মানুষকে আলদা করে দেখেননি। জগতের সকল মানুষকে এক করে দেখেছেন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। কবির ভাষায়-‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সে জাতির নাম মানুষ জাতি’/এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত একই রবি শশী মোদের সাথী/মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এক। কিন্তু চেহারা হয়ত ভিন্ন। মাথা চোখ কান দাত, নাক মুখ হাত পা প্রত্যেকেরই সমান। কিন্তু পার্থক্য চিন্তা ও চেতনায়। ধর্মে ও কর্মে। এক একজন মানুষ একই বিষয় ভিন্ন ভিন্নভাবে চিন্তা করতেপারে। বুদ্ধি চর্চা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনা করতে পারে। জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় কেউ হতে পারেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী এরিস্টটল, নিউটন, আবার কেউ হতে পারেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়র আবার কেউ বা সুযোগের অভাবে নিরক্ষর, কলম ধরতেও জানে না-এখানেই মানুষের পার্থক্য। কিন্তু তাই বলে এক মানুষ অপর মানুষের শত্রæ হতে পারে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ গোত্র যতটুকু মানুষকে পৃথক করেছে, কিন্তু এ কারণে সে কখনো দায়ী নয়, কারণ এ ব্যাপারে মানুষের কোন হাত নেই। এছাড়া কোনো ধর্ম বা নীতিশাস্ত্র মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না। ধর্ম হচ্ছে শান্তির প্রতীক। মানবকল্যাণ, শান্তি ও সম্প্রীতি ধর্মের প্রধান কাজ। যুগে যুগে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মেও শান্তি, ভালবাসা, সেবা ও পরোপকারের আদেশ দেয় এবং হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ ও সহিংসতা পরিহার করতে বলে। বিভিন্ন ধর্ম বলা হয়েছে মানুষকে ভাল করে মানুষের কল্যাণ কর, সুখ শান্তি দান করো এবং সর্বজীবে দয়া করো।
আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সা গুরুত্বারোপ করেছেন মানুষে মানুষের মিলন, সৌহার্দ ও সহিষ্ণুতার ওপর সংকীর্ণতা ও বিবেধের ওপর নয়।
কিন্তু দুখজনক হলেও সত্য ধর্মের নামে এক শ্রেণীর মানুষ অধর্ম ও উগ্রবাদ কায়েম করছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষকে মানুষের শত্রæ বানাচ্ছে। ধর্মীয় কারণে ইউরোপে সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রোটেস্টান্ট ও ক্যাথলিক দু’টি খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ৩০ বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল যুগে যুগে ধর্মীয় সংঘাতে প্রাণ দিয়েছে অসংখ্য মানুষ। এই তো কিছুদিন অগে নিউজিল্যান্ডের সমজিদে কুখ্যাত খ্রিস্টান যুবেকের নির্বিচার গুলিতে প্রাণ হারান ৫০ এর বেশি নিরপরাধ মানুষ। ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। অমেরিকা সমঅধিকার দাবির স্বার্থে প্রাণ দিয়েছেন নিগ্রো নেতা মার্কিন লুথার কিং, প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং রবার্ট ফেলেডি।
প্রকৃত ধর্ম কখনও মানুষকে ক্ষতি করতে বলে না-মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়। আমাদের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সা. বিশ্ব মানবতা ও ক্ষমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখায়ে গেছেন। তায়েফের ময়দানে পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হওয়ার পর শত্রæকে ক্ষমা করেছেন, বলেছেন, ‘এদের জ্ঞান দাও, প্রভু এদের ক্ষমা কর। এছাড়া মক্কা বিজয়ের পরে শত্রæকে অনুকলে পেয়েও প্রতিশোধপরায়ন হয়নি, বরং ক্ষমা করে দিয়েছেন। মানুষ হয়ে মানুষের প্রদি দয়া ও মহানুভবতার এমন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল।
রাজনৈতিক মতাদর্শগুণ ভিন্নতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার। একই পরিবারের সদস্য হওয়া সত্বেও ভিন্ন ভিন্ন পথ-মত অস্বাভাবিক বা দূষণীয় কিছু নয়। কি যে রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মুখোশে চলে স্বৈরতন্ত্র। চলে ক্ষমতা ধরে রাখার অবৈধ প্রচেষ্টা। সে রাষ্ট্রে রাজনৈতিক হয়ে দাড়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ জাতীয় রাষ্ট্রে শাসক দল সব শ্রেণীর মানুষের জন্য না হয়ে গুটিকয়েক মানুষের স্বার্থের দাসে পরিণত হয়।
অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি, রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে চলছে প্রতিযোগিতা। খোড়া অজুহাতে চালিয়ে দিচ্ছে অবৈধ যুদ্ধ বিগ্রহ। ১৯৪১ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ও ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমনে অকালে প্রাণ হারায় অসংখ্য মানুষ। লÐভÐ হয়ে যায় জপানের হিরোসিমা ও নাগরিক শহর। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় এক অসম যুদ্ধ। নিরীহ বাঙালির ওপর আধুনিক অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শহীদ হন ৩০ লাখ মানুষ এবং সম্ভ্রমহানি হয় কয়েক লাখ মা-বোনেরা। ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ এশনকি জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একঅযৌক্তিক অসম এবং অবৈধ যুক্ত করে ইরাক আক্রমন নিরীহ লোক হত্যা ও সমুদ্র বিনষ্ট করে। নারী ও শিশুসহ কয়েক লাখ মানুষ নিহত হয়। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মির্মমতায় ১০/১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, ফিলিস্তিন প্রভৃত দেশে যুদ্ধ এখনো চলমান, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জম্মু ও কাশমরীর সীমান্ত প্রতিনিয়ত প্রাণ হরাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণালব্ধ মানব বিধ্বংসী মরণান্ত্রের কাছে ভূলুণ্টিত হচ্ছে মানবতা। মানুষ মানুষের জন্য না হয়ে মানুষই হয়েছে মানুষের শত্রু। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-হত্যা কখনও মানুষকে শান্তি দেয়নি। দিতে পারেনা, তাই এটা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হবে। এজন্য বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিতে হবে। বিশ্ববিবেক জাগ্রত না হলে মানুষ হত্যার এ লীলা কখনো বন্ধ হবে বলে মনে হয়না।
মানুষকে ক্ষতির চিন্তা করার আগে অবশ্যই ভাবা উচিত সেও আমার মতো একজন মানুষ। সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেককে একটি করেই প্রাণ দিয়েছেন। পৃথিবীর আলো বাতাসের অধিকার আমার মত তারও রয়েছে। এ ছাড়া যুগে যুগে মানুষই মানুষের কল্যাণ করেছে। এ পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করেছে মানুষ। মুমূর্ষু মানুষকে রক্তদান করেছে মানুষ, মানুষকে চরম বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে মানুষ। আর মানুষকে ভালবাসলে সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসা হয়। কথায় আছে- ‘মানবসেবাই পরম ধর্ম’ স্বামী বিবেকানন্দ তাই বলেছেন ‘জীবে প্রেম করে যে জন সেই জন সেবিয়েছে ঈশ্বর। কবি বলেছেন ‘শোনই মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মানুষের জয়গান করেছেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে তিনি এক ভেবেছেন। তাই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে মহীয়ান আর কিছুই নেই। কবির ভাষায়, গাহি সাম্যের গান মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই নহে কিছু মহীয়ান। তাই মানুষকে যে কোনো মানুষের জন্য কাজ করতে হবে। কেননা সর্বদা, আমাদের মনে রাখা উচিত মানুষের প্রয়োজনেই মানুষ তাই মানুুষ হইতে হবে মানুষ যখন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট