সৃষ্টির সেবায় নিবেদিত মহামনীষী হযরত মতিয়র রহমান শাহ (ক.)

165

বার আউলিয়ার পুণ্যভঊমি চট্টগ্রাম জেলার আধ্যাত্মিক নগরী নামে পরিচিত ফটিকছড়ি উপজেলার মতিভান্ডার দরবার শরীফের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বেলায়তে ওজমা তথা উন্মুক্ত আধ্যাত্মবাদ দর্শনের অধিকারী রুহুল আশেকীন মজ্জুবে সালেক গাউছে ভান্ডার হযরত মতিয়র রহমান শাহ (ক.) প্রকাশ শাহ ছাহেব কেবলা ১৮৯৮ সালের ৮ মার্চ, ২৪ ফাল্গুন শতাব্দীর শেষ লগ্নে জন্মগ্রহণ করেন। সংখ্যা তত্ত¡ মতে ৮ সংখ্যা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার প্রতিক আর ২৪ সংখ্যা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সংখ্যা নামে পরিচিত। মাতৃগর্ভজাত আউলিয়া শাহ ছাহেব কেবলা ৮ ও ২৪ সংখ্যার সমন্বয়ে জন্মেছেন।
পরবর্তীতে তার জীবন চরিত, দর্শন, আদর্শ, অকাতরে মানুষের প্রতি দয়া, সব মিলে দুই সংখ্যার সমন্বয় আমরা দেখতে পাই। তার নাম অনুসারে পূর্ব ফরহাদাবাদ গ্রাম মতিভান্ডার দরবার শরীফ নামে পরিচিত। পীরানে পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (ক.) যেমন মাতৃগর্ভে থাকাকালীন মা’কে সর্প দংশন হতে রক্ষা করেন,তদ্রুপ তিনিও মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় স্বীয় মাতাকে হারাম মাছ ভক্ষণ হতে রক্ষা করেন। শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন মাইজভান্ডার দরবার শরীফের আধ্যাত্বিক পরিমন্ডলের যুবরাজ। বিভিন্ন ঘটনা ও মনীষীদের বাণী থেকে এর যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। গাউছে ভান্ডার শাহ ছাহেব কেবলা প্রায়শই দরবারে গমন করতেন। কোনো সময় জজবা হালে আবার কোনো সময় ছলুক অবস্থায়। অছিয়ে গাউছুল আজম সৈয়দ দেলোয়ার হোসেন মাজইভান্ডারী গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিলের বারান্দায় বসা অবস্থায় শাহ ছাহেব কেবলা দরবারে গেলে অতি সম্মান সহকারে পার্শ্বে চেয়ারে বসাতেন এবং সর্বোচ্চ আপ্যায়ন করতেন। অনেক সময় দুজনের মধ্যে দীর্ঘ কথোপকথন চলতো। এমন একদিন দরবার শরীপের মাওলানা সৈয়দ মাহফুজুর করিম সাহেব দেখলেন, অছিয়ে গাউছুল আজম শাহ ছাহেব কেবলাকে অতি আদর ও সম্মান সহকারে আপ্যায়ন করাচ্ছেন। মাওলানা সৈয়দ মাহফুজুল করিম সাহেবের সাথে শাহ ছাহেব কেবলার একটি নিবিড় আধ্যাত্মিক সম্পর্ক ছিল। তাকে খুবই মান্য করতেন। এতদসত্তে¡ও শাহ ছাহেব কেবলার শান, মান, মর্যাদা এবং তাঁকে অছিয়ে গাউছুল আজম কেনইবা এতো সম্মান প্রদর্শন করছেন এই সব নিয়ে ভাবতে লাগলেন। সেদিন রাতে মাওলানা সাহেব স্বপ্নে দেখেন যে দরবার শরীফের ময়দানে বিশাল মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে, মঞ্চে একটি রাজকীয় সিংহাসন আছে। মাঠভর্তি পাগড়ী পরা মানুষ। উপস্থিত সবাই আলোচনা করছেন মাইজভান্ডার শরীফের যুবরাজ আসবেন সেইজন্য এই আয়োজন। এমতাবস্থায় মাওলানা সাহেব অছিয়ে গাউছুল আজমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘সবাই যে যুবরাজের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তিনি কে’ ? এই কথা বলা মাত্র অছিয়ে গাউছুল আজম ইঙ্গিত করলেন, ঐ দেখ যুবরাজ আসছেন’। তিনি আর কেউ নন, গাউছে ভান্ডার হযরত মতিয়র রহমান শাহ (ক.)। তিনিই মাইজভান্ডার শরীফের যুবরাজ। শাহ ছাহেব কেবলা মঞ্চে উঠে সিংহাসনে উপবেশন করলেন। উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন। এরপর মাওলানা সাহেব তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হলেন এবং শাহ ছাহেব কেবলার প্রতি তাঁর ভক্তি শ্রদ্ধা আরো বৃদ্ধি পেলো। হযরত কেবলা গাউছুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (ক.) এর সাথে ছিল গভীর আত্মিক সম্পর্ক। শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন হযরত কেবলার উলুহিয়ত তথা রুহানী সন্তান। জন্ম থেকেই তিনি হযরত কেবলার দয়া প্রাপ্ত হন। তাই হযরত কেবলার উন্মুক্ত আধ্যাত্মবাদের মূল অংশ শাহ ছাহেব কেবলার মাধ্যমে বিকশিত করেন। একইভাবে তিনি বাবা ভান্ডার হযরত গোলামুর রহমান শাহ (ক.) মাইজন্ডারী ফয়েজ ও করুণা প্রাপ্ত হন। শাহ ছাহেব কেবলার বেলায়তের ধারা হযরত কেবলার মাধ্যমে শুরু হলেও বেলায়তের পূর্ণ ক্ষমতা অর্জন করেন বাবা ভান্ডারীর নিকট থেকে।
একদা শাহ ছাহেব কেবলাবাবা ভান্ডারীর নিকট গমন করলে আসন মোবারকের নিচ থেকে সংরক্ষিত কতগুলো রান্না করা গরুর নলা তাঁকে দেন। তিনি এগুলো মাথায় করে নিয়ে আসেন। ঐ সময় উপস্থিত হযরত কেবলার অন্যতম খলিফা হযরত রিজওয়ান শাহ (ক.) অন্যান্য আশেকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাবা ভান্ডারী কেবলার যোগ্য খলিফা থাকা সত্তে¡ও মাইজভান্ডারী সিংহাসন মতিয়র রহমান শাহ (ক.) দিয়ে দেন‘। এইভাবে বাবা ভান্ডারী কেবলার করুণা অর্জনের মাধ্যমে মাইজভান্ডার আধ্যাত্মিক সিংহাসনের অধিকারী হন এবং বেলায়তের পূর্ণ ক্ষমতা হযরত মতিয়র রহমান শাহ (ক.) এর নিকট স্থানান্তরিত হয়।
তিনি মানুষকে অকাতরে না চাইতেই দয়া করেছেন। যে ব্যক্তি একবার তাঁর সান্নিধ্যে গেছেন তিনি দয়া প্রাপ্ত হন। মৃত লোককে জিন্দা করা, সময়কে স্থির করে রাখা, বিনা মেঘের বৃষ্টিপাতসহ বৃষ্টি, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রি হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী, কঠিন রোগ থেকে মুক্তি নাকেশ বান্দাকে কামেল আউলিয়াতে পরিণত করা, ৭১ সালের স্বাধীনতার ভবিষ্যৎ বাণী সহ লক্ষাধিক কেরামতের নজির রয়েছে।
তিনি মানুষকে শুনিয়েছেন সুবুদ্ধির বাণী, দেখিয়েছেন আলোর পথ। তাঁর ওফাত পূর্ববর্তী যেভাবে মানুষ অনায়াসে দয়া প্রাপ্ত হয়েছেন তদ্রুপ ওফাত পরবর্তী তাঁর মাজার শরীফ হতে করুণা হাসিল করছেন এবং বর্তমানেও পাচ্ছেন।
তাঁর শান, মান বর্ণনা করতে গিয়ে বিভিন্ন আউলিয়া ও শায়েররা বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। আল্লামা হযরত আজিজুল হক শেরে বাংলা (রহ.) তাঁর দিওয়ানে আজীজ কিতাবে লিখেছেন, ‘হযরত মতিয়র রহমান শাহ হলেন মজ্জুবে সালেক, আরিফ বান্দাদের আদর্শ, আউলিয়াদের চোখের মণি, কাশফ ও কেরামতের খনি, যুগখ্যাত বুযুর্গ এবং তাঁর মাজার শরীফ সৃষ্টিক‚লের মিলনকেন্দ্র ও জান্নাতের বাগান’।
সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী বলেছেন, ‘পূর্বফরহাদাবাদের মতিয়র রহমান শাহ এমন একজন আউলিয়া যার কোনো তুলনা নেই’।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত শায়ের সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তাঁর শান মান বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেন, ‘রহমানি আদত হে তুম মে হো মতিয়র রহমান, তুমহারি শান হে আলিশান’। অন্য প্রশংসাগীতিতে লেখেন, ‘ওয়াক্বিফে রাযে হাকিকত্ব হে মতিভান্ডারী, মাওলা ভান্ডারী কি সুরত হে মতি ভান্ডারী’।
বর্তমান অশান্তিময় বিশ্বকে শান্তির পথ দেখাতে শাহ শাহেব কেবলার নির্দেশিত সু-বুদ্ধির পথে চলো, সু-বুদ্ধিতে খোদা, সু-বুদ্ধির পথ অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি। শাহ্ কেবলা বলেছেন, ‘সু-বুদ্ধির পথে চলো, সু-বুদ্ধিতে খোদা, সু-বুদ্ধিতে রাসূল (সা.), সু-বুদ্ধিতে কোরআন, সু-বুদ্ধিতে ইসলাম, সু-বুদ্ধিতে ইমান সর্বোপরি সু-বুদ্ধিতে মানবতা।’ বর্তমানে বিশ্বময় অশান্তির আগুনে জ্বলছে। যেদিকে তাকাইনা কেন মানুষ সু-বুদ্ধির পথ হতে বিচ্যুত হয়ে কু-বুদ্ধির পথ অবলম্বন করার কারণে মানুষ বিপদগামী হচ্ছে। এই কু-বুদ্ধির পথ পরিহার করে মতিয়র রহমান শাহ কেবলার আত্মদর্শন সু-বুদ্ধির পথ গ্রহণ করে বিশ্ব থেকে হানাহানি, মারামারি, ঘৃণা বোমাবাজি, জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ দূর করা সম্ভব। তাহলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হবে। মানুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। তাহলেই বিশ্বশান্তি সু-নিশ্চিত। শাহ ছাহেব কেবলার পরবর্তী তারই নির্দেশিত পথকে অনুসরণ করেছেন সাজ্জাদানশীন ও তদীয় প্রধান খলিফা হযরত শাহ ছুপী মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ (ক.)। তিনি ছিলেন শাহ ছাহেব কেবলার আদর্শের ধারক ও বাহক। তিনিও পরবর্তীতে মানবতার কল্যাণে তথা শাহ ছাহেব কেবলার সু-বুদ্ধির পথ, দর্শন ও আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে ভক্তদের শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়েছেন। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৬৪ সালের বাংলা ২১ মাঘ ধরাধাম ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে মহামিলনে গমন করেছেন। প্রতিবৎসর এই দিনে শাহ ছাহেব কেবলার বার্ষিক ও বশশরীফ তথা আশেকের মিলনমেলা দরবারস্থ ফয়েজিয়া মঞ্জিলের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক