সুস্থ সমাজ বিনির্মাণে ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাণিত প্রতিরোধ প্রয়োজন

91


আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই যে খবরটি পড়ে অভিভাবক এবং বিবেকবান মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয় তাহলো-ধর্ষণ। শব্দটা মিসাইলের চেয়েও ভয়ংকর। মিসাইল নামের মারণাস্ত্রে মানুষ মারা যায় বটে কিন্তু যাঁরা বেঁচে থাকে তাঁদের কোনো ধরনের গদ্বানি বয়ে বেড়াতে হয় না। কিন্তু যে মেয়েটি বা মহিলাটি ধর্ষণের শিকার হন তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা একজন মানুষকে শতবার খুন করার শামিল। আমাদের সমাজে একজন মেয়ে মানুষ যেভাবে হোক একবার নির্যাতনের শিকার হলে পরবর্তী পর্যায়ে তাঁকে শতবার মানসিকভাবে ধর্ষণের শিকার হতে হয়। আমাদের সমাজ -সমাজ ব্যবস্থা যতটা সহমর্মী তার চেয়ে বেশি কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে ওস্তাদ। যে মেয়েটি নির্যাতনের শিকার হলো সে যদি কোনো পরিবারের বউ হন তাহলে তাঁর ওপর প্রথম খড়গটি নেমে আসে স্বামী নামের পুরুষটির পক্ষ থেকে। পুরুষটি যদিও ভালোভাবে জানে এতে তাঁর স্ত্রীর কোনো দোষ নেই, তবু তাঁকে তিনি নিশ্চিত ত্যাগ করবেন অথবা পরিবারে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবেন যাতে মহিলাটি স্বেচ্ছায় শ্বশুর-বাড়ি ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এবার মহিলাটি হয়তো বাপের বাড়ি গেলেন এতটুকু আশ্রয়ের জন্যে। দেখা যাবে সেখানেও নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে আছে । যে পরিস্থিতির কারণে মেয়েটির শেষ পরিণতি হয়, হয়তো গলায় দড়ি কিংবা নিরুদ্দেশ। এভাবে কারো বোন কিংবা মেয়ে যদি নির্যাতনের শিকার হন তাঁদের পরিবারেও নেমে আসে সীমাহীন মানসিক যন্ত্রণা। একদিন আগেও যে বোন ভাইয়ের চোখের মনি কিংবা বাবার কলিজার টুকরো ছিল দিন গড়াতেই সে হয়ে ওঠে বিষের পেয়ালা।
অন্যদিকে যিনি ধর্ষক, ভাদ্র মাসের কুকুর হয়েও তিনি দিব্যি বুক ফুলিয়ে সার্টের বোতাম খোলা রেখে মাঠে-ময়দানে হাওয়া খেলেও কেউ তার টিকিটি স্পর্শ করতে পারেন না। গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে কিংবা বড়ো ভাইয়ের আশীর্বাদে বেরিয়ে এসে নির্যাতিতার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দেখে নেবার হুমকি দেন। অন্যদিকে সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো যে মা-বাবা জানেন তাঁদের ছেলে লম্পট, তবু তাঁরা সাফাই গেয়ে চলেন তাঁদের ছেলের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র। আবার গ্রামীণ সমাজে এ জাতীয় ঘটনা ঘটার পর অনেক মা-বাবা কিংবা পরিবারের সদস্যদের বলতে শোনা যায় আমাদের ষাঁড় বেঁধে রাখা সম্ভব নয়-তোমাদের গাইকে সামলাও। দুর্বলের ওপর এই হলো সবলের অলিখিত ফরমান। একজন মায়ের জাত আরেক মায়ের ওপর যেভাবে কলংক চাপিয়ে দেন তা দেখে মনে হয় তিনি স্বার্থের জন্যে পৃথিবীর যত অপকর্ম আছে সবটাই করতে পারেন।
যে কারণে হোক যেভাবে হোক ধর্ষণ যে হারে বাড়ছে তা যদি মহামারিরূপে আবির্ভূত হয় তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই থাকবে না। আগে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মেয়েদের ধর্ষণের শিকার হতে দেখা গেছে। কিন্তু এখন ধর্ষকদের হাত থেকে শিশু হতে বৃদ্ধ কেউ রেহাই পাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে নির্যাতিত শিশু-নারীকে। এসব নরকের কীট বীর পুরুষরা ধর্ষণের পূর্বে একটুও ভেবে দেখেন না যে, তাঁদের ঘরেও সেরকম শিশু বা বোন বা মা রয়েছে। স¤প্রতি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,চ্চলতি বছরের প্রথমার্ধে গড়ে মাসে অন্তত ৪৩টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অথচ গত বছর এই হার ছিল এর অর্ধেকের মতো। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নিয়মিত মানবাধিকার প্রতিবেদনে শিশু ধর্ষণের এই হিসাব পাওয়া গেছে। আসকের হিসাবে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে মোট ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৬৩০টি। এগুলোর অর্ধেকের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স ১৮ বছর বা তার নিচে। ধর্ষণ ও ধরনচেষ্টার কারণে শিশু হত্যার ঘটনা ঘটেছে ২১টি। ধর্ষণের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে ৭থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুরা।”( প্রথম আলো, ১০/০৭/২০১৯)
উপর্যুক্ত তথ্য থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তাহলো নির্যাতনের শিকার প্রতি দুই জনের মধ্যে একজন শিশু। আবার তাদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুর বয়স ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। বিষয়টি পরিবার ও সমাজের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। এভাবে শিশুরা নির্যাতনের শিকার হতে থাকলে অভিভাবকেরা নিজেদের শিশুদের নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। আর এ নিরাপত্তাহীনতা মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলবে অভিভাবকদের কর্মক্ষেত্র এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অভিভাবকদের মনে যদি এ আশংকাবোধ জেগে ওঠে যে, ঘরে -বাইরে, স্কুলে-মাদ্রাসায়, চলন্ত ট্রেনে-বাসে যাওয়া-আসার পথে কোথাও তাঁদের শিশুরা নিরাপদ নয়, যে কোনো স্থানে তাদের শিশুরা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন তখন তাঁরা শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো বন্ধ করে দিতে পারেন। অন্যদিকে শিশুদের বাইরে পাঠিয়ে তাঁরা যদি নিশ্চিন্ত হতে না পারেন তবে তার প্রভাব পড়বে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে। এভাবে পরিবার ও সমাজে অস্থিরতা বাড়বে। এ ব্যাপারে শিশু অধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের মতে, ধর্ষণ মহামারিতে রূপ নেয়ার আগেই সব দিক থেকে প্রতিকার-প্রতিরোধের কাজ শুরু করা জরুরি। কিন্তু সেরকম তৎপরতা খুব একটা লক্ষণীয় নয়। চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা ঘটলে কিংবা সাধারণ মানুষ এ ব্যাপারে সোচ্চার হলে কিংবা নির্যাতিতার সহপাঠিরা রাস্তায় নামলে, সে সঙ্গে গণমাধ্যম মাতামাতি করলে প্রশাসন ও নাগরিক সমাজ কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ করে। তারপর সব থিতিয়ে পড়ে। এ অবস্থা কিন্তু চলতে দেয়া যায় না।
শিশুদের প্রতি যে হারে সহিংসতা ও হিংস্রতা বাড়ছে তার কারণ হিসেবে নানা জন নানা মত পোষন করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, মাদকাসক্তি, শিশুর আচরণগত সমস্যাকে গুরুত্ব না দেয়ায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে অনেকে মনে করেন। অনেকের মতে শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবারকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ তাঁদের মতে শিশুদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে ঘরের ভেতরে-আপনজনদের মাধ্যমে। তবে একটি শিশু বা একজন নারী যেখানে যে অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হোক না কেন আমরা যে শিশুদের কিংবা নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা একেবারেই নিশ্চিত করতে পারিনি এ কথা শতভাগ সত্য। এ সুযোগে ঘটে চলেছে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে শিশু নির্যাতন বাড়ার পেছনে বিচারহীনতা ও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা উল্লেখযোগ্য কারণ। ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধ করেও অপরাধী ব্যক্তি গ্রেফতার হয় না। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও তারা বিচার এড়িয়েই চলতে পারে।
ধর্ষণের মতো মারাত্মক সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে জিততে হলে আমাদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রæতকরণের জন্যে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করতে হবে। শুধু ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই হবে না, নতুন করে ধর্ষক সৃষ্টি যাতে না হয় কিংবা এ জাতীয় জঘন্য কাজে কেউ যাতে প্রবৃত্ত হতে সাহস না করে এজন্য ধর্ষক ও ধর্ষকের পরিবারকে সামাজিকভাবে এক ঘরে করতে হবে। তাঁদের ছেলেমেয়ের বিয়ে কিংবা যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান পাড়া-প্রতিবেশি একজোট হয়ে বর্জন করতে হবে। মনে রাখতে হবে বেশিরভাগ ধর্ষণ ঘটনার পর ধর্ষককে বাঁচাতে সন্ত্রাসী -মাস্তান কিংবা প্রশাসনের অসাধু লোকজন কিংবা অর্থবিত্তের মালিক কিংবা গড়ফাদারদের কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন। ধর্ষকদের সঙ্গে এসব তদবির পার্টির লোকজনদের ধর্ষণ-কাজে সহযোগি হিসেবে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নীতি ও নৈতিকতার স্বার্থে কারো বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠলে তিনি নিরাপরাধ প্রমাণিত না হওয়া অবধি তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। মা-বাবাকে তাঁদের কন্যা সন্তানদের চোখে চোখে রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বাস নামক শব্দটাকে পুরোপুরি পরিহার করে নিজের ভার নিজেকেই নিতে হবে। বলাতো যায় না কখন কোন পুরুষের ওপর শয়তান সওয়ার হয়, আর সে শয়তানের কবলে আপনার নিষ্পাপটি শিশুটি যাতে না পড়ে তার জন্যে আপনি ছাড়া ভালো রক্ষাকবচ আর কে হতে পারে? তবে ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী জঘন্য অপকর্ম থেকে আমাদের আগামী প্রজন্ম-মায়ের জাতকে বাঁচাতে প্রয়োজন প্রচলিত আইনের আমূল সংস্কার এবং সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে অপরাধীর সাজা নিশ্চিতকরণ। আশার কথা বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। গত ১১ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে ধর্ষণের বিচার-সংক্রান্ত আইন আরো কঠোর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন,” আমাদের আইনটা আরো কঠোর করা দরকার। এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ কখনো মেনে নেওয়া যায় না। তিনি গণমাধ্যমকে ধর্ষণকারীর চেহারা বার বার দেখানোর আহবান জানান,যাতে তাদের লজ্জা হয়।”(প্রথম আলো-১২/০৭/২০১৯)।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক