সুফি ব্যক্তিত্ব আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ)

115

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

প্রখ্যাত সুফি ব্যক্তিত্ব, ওয়ায়েজিন, উস্তাজুল উলামা শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মালেক শাহ (রহ.)। নির্লোভ. নিরহংকার জনদরদী মানবব্রতী এ দ্বীনদার ব্যক্তিত্বের ৬৩ বছরের জিন্দেগি ছিল বহুমুখী গুণ-বৈশিষ্ট্য সমুজ্জ্বল। শিশুর মতো সারল্য, ছোট বড় সবার প্রতি সদাচরণ, সহজ সরল নির্মোহ নির্লোভ গুণ তাঁকে অনন্য মর্যাদায় উন্নীত করেছে। তিনি ছিলেন বাহরুল উলুম তথা জ্ঞানসমুদ্র। কুরআন হাদিস ফিকহ আকাইদ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা ও পাÐিত্য দেখে অভিভ‚ত হতে হয়। আরবি, উর্দু, ফার্সিসহ মাতৃভাষা বাংলায় তাঁর সবিশেষ দক্ষতা ও পারঙ্গমতা ছিল অসাধারণ। আল্লামা আবদুল মালেক শাহ ছাহেব কেবলা (রহ) ছিলেন একজন ওয়ায়েজ বা জনপ্রিয় বক্তা। বক্তব্যের প্রখরতা ও জ্ঞানের গভীরতা তাঁর ওয়াজ শুনলে উপলব্ধি করা যেতো। শ্রোতাদের তুষ্ট করতে তিনি ওয়াজ মাহফিলে কৃত্রিম ভড়ং দেখাতেন না। কুরআন হাদিসের আলোকে জীবনঘনিষ্ঠ নির্মোহ বক্তব্য রাখতেন। শ্রোতারা পিন পতন নীরবতা ও নিবিষ্ট মনোযোগে তাঁর ওয়াজ শুনতেন এবং দ্বীন ও সুন্নিয়তের দিশা পেয়ে তাঁরা ধন্য হতেন।
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার (ভ‚জপুর থানাধীন) সুয়াবিল গ্রামে তিনি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত কবি আদু মিয়া এবং মাতা মাহমুদা খাতুন। তাঁর দাদা ছিলেন বিখ্যাত জমিদার আলহাজ্ব মুহাম্মদ ফজু মিয়া এবং দাদি মুহতরমা ছুরতজমান খাতুন। তাঁর পিতা কবি আদু মিয়া ছিলেন গাউসুল আজম শাহসূফি আল্লামা সৈয়দ আহমদুল্লাহ মাইজভান্ডারীর (ক.) খলিফা মুফতিয়ে আজম আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (রহ.) এর একনিষ্ঠ মুরিদ। তিনি মাইজভান্ডার দরবার শরিফের সিলসিলা অনুযায়ী চলতেন এবং ঈমানি জজবাপূর্ণ ছেমা মাহাফিল পরিচালনা করতেন। পিতা-মাতা উভয় দিক থেকে বুজুর্গ খান্দানি বংশীয় ঔজ্জ্বল্য তাঁকে মহিমান্বিত জীবনের অধিকারী করেছে। নিজ গ্রামের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন মাওলানা কাজী মুহাম্মদ আবুল খায়েরের (রহ) নিকট তিনি শিশু অবস্থায় কুরআন মজিদ তথা দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। এরপর পিতার ইচ্ছানুযায়ী ফটিকছড়ি নাজিরহাট জামিয়া মিল্লিয়া আহমদিয়া কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে সেখান থেকে দাখিল-আলিম পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর এশিয়াখ্যাত দ্বীনি শিক্ষালয় চট্টগ্রাম ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল (ডিগ্রি) শ্রেণি অধ্যয়ন শেষে বরিশাল শর্ষিনা দারুস সুন্নাত আলিয়া মাদ্রাসা হতে কামিল হাদিস, পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ওয়াজেদিয়া আলিয়া মাদ্রাসা হতে কামিল ফিক্হ এবং আরো পরে হাটহাজারী ছিপাতলি জামেয়া গাউসিয়া মুঈনিয়া আলিয়া মাদ্রাসা হতে কামিল তফসির সনদ লাভ করেন। সকল পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। শিক্ষা জীবন শেষ করে নাজিরহাট আলিয়া, এরপর হাটহাজারী গুমামর্দ্দন ইসলামিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন উচ্চতর ক্লাসে শিক্ষকতা করেন। এরপর দীর্ঘ সতের বছর ছিপাতলি আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল (ফিক্হ) বিভাগের প্রধান ফকিহ পদে ছিলেন। এরপর চট্টগ্রাম বায়েজিদ জালালাবাদ আহছানুল উলুম জামেয়া গাউসিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় শায়খুল হাদিস তথা প্রধান মুহাদ্দিস পদে ছিলেন ওফাতের আগ পর্যন্ত। এ সকল মাদ্রাসায় উচ্চতর ক্লাসে পাঠদানের জন্য তিনি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ভ‚য়সী প্রশংসা অর্জন করেন। তাঁর হাজার হাজার ছাত্র-শিষ্য আজ দেশে-বিদেশে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে সুন্নিয়ত ও তরিকতের খেদমতে নিবেদিত আছেন। অনেকে মানুষের সেবাসহ নানা পেশায় নিজেদের ব্যাপৃত রাখছেন।
আল্লামা আবদুল মালেক শাহ ছাহেব কেবলা (রহ.) আজীবন মাইজভান্ডার দরবার শরিফের সঙ্গে নিবিষ্টভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি অছি-এ গাউসুল আজম, খাদেমুল ফোকরা হজরত শাহসুফি দেলাওর হোসাইন আলমাইজভান্ডারী (ক.)এর একনিষ্ট মুরিদ ও খাদেম ছিলেন। মাইজভান্ডার শরিফ আনজুমানে মোত্তাবেয়ীনে গাউসে মাইজভান্ডারীর কেন্দ্রীয় দারুত তালিমের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি দ্বীন, সুন্নিয়ত ও তরিকতের প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে আনজুমানে গোলামানে মোস্তফা (দ) বাংলাদেশ নামে একটি অরাজনৈতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর যোগ্য সন্তানদের প্রচেষ্টা ও তত্ত্বাবধানে তাঁরই বাড়ি প্রাঙ্গণে ২০০৭ সনে গাউসিয়া হোসাইনিয়া আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ) সুন্নিয়া মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। যা তৃণমূলে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে ভ‚মিকা রাখছে।
আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ) স্ত্রী রোকেয়া বেগম, পাঁচ ছেলে ও দুই কন্যা রেখে গেছেন। হুজুর কেবলার (রহ) সকল যোগ্য সন্তান নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। চারজনই আলেমে দ্বীন। তাঁরা দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত। আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ) এবং আমার আব্বা (আল্লামা নুরুল আলম খান (রহ.)) সম্পর্কের দিক থেকে পরস্পর বেয়াই। অর্থাৎ আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ) এর ছোট ছেলের শ্বশুর। ২০০৬ সনের ২৭ জুন মঙ্গলবার আল্লামা আবদুল মালেক শাহ (রহ) ইন্তেকাল করেন। তিনি শানে মুস্তাফা (দ) এর ওপর ত্রিশ খন্ডের একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করে গেছেন- যা বাংলায় অনূদিত হওয়া সময়ের দাবি। মাজভান্ডার দরবার শরীফের আহমদিয়া মঞ্জিলের শাহী ময়দানে ১ম দফাসহ তিন দফা নামাজে জানাযা শেষে বাগে হোসাইনস্থ বাড়ি ও মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নামাজে জানাযায় মানুষের ঢল দেখে প্রমাণিত হয় তিনি কত বড় বরেণ্য আলেমে দ্বীন ছিলেন। আজ ৫ ডিসেম্বর তাঁর ১৪তম বার্ষিক ওরশ শরীফ এবং তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসার ১৩তম সালানা জলসা।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক