সুন্দরবনে নতুন পটকা মাছের সন্ধান

116

পৃথিবীতে আবিষ্কৃত মোট প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ৮৭ লাখ। তার সাথে আর একটি নতুন প্রাণ যুক্ত হলো বলে বাংলাদেশি মৎস্য বিজ্ঞানিরা দাবি করছেন। তাঁরা বলছেন বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় পটকা জাতীয় একটি মাছের বসবাস সম্প্রতি ঢাকার একটি শীর্ষ স্থানীয় দৈনিকে এ তথ্য প্রকাশ হয় (প্রথম আলো ২৬ ডিসেম্বর ২০১৯)। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী আহসান হাবিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ার একদল গবেষক এই পটকা জাতীয় মাছটি আবিষ্কার করে। দক্ষিণ কোরিয়ার মেরিন ইকোসিস্টেম রিচার্স সেন্টারের তিনজন গবেষক এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পত্রিকায় মাছের তিনটি রঙ্গিন ছবি ছাপা হয়।
তারা জানান, সুন্দরবনের দুবলাচরের আলোর কোলে মাছটি পাওয়া যায়। মাছটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয়েছে বঙ্গোপসাগরের নামানুসারে, ‘চেলেনোডনটপস বেঙ্গালেনসিস’। এই মাছের গায়ের রঙ কালচে। পিঠের উপরিভাগে জালের মতো ছোট ছোট দাগ আছে। বিজ্ঞানিরা তাই এর বাংলা নাম রেখেছেন ‘বড় জালি পটকা’। সুন্দরবনের জেলেদের জালে কালেভদ্রে মাছটি ধরা পড়ার সংবাদ আছে। জেলেরা একে ‘বড় পটকা’ নামে ডাকে। তবে এই মাছ তারা খায় না। জালে ধরাপড়ার পর ফেলে দিতেন। কুকুর, বিড়াল, শিয়ালসহ বন্য প্রাণীরা খাওয়ার তথ্যও নেই।
সংবাদপত্রের তথ্যানুযায়ী শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়া কালচার অ্যান্ড মেরিন সাইন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক কাজী আহসান হাবিব জানান যে, ‘মাত্র দেড় বছরের মাঠ পর্যায়ের কাজ করে আমরা সুন্দরবনের জন্য তো বটেই। বিশ্বের জন্য নতুন একটি প্রজাতি খুঁজে পেলাম। নতুন এই আবিষ্কার বিশ্বের মৎস্যবিজ্ঞান গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে’। ২০১৬ সালের মে থেকে ২০১৭ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনে তারা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালিয়ে মাছটি খুঁজে পান। এই অনুসন্ধানে আর্থিক সহায়তা করে দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়াসু কোরিয়া ফাউন্ডেশন। আর কারিগরি সহযোগিতা দেয় কোরিয়া ইনস্টিটিউট অব ওশান সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘ওশান সায়েন্স- এর নতুন প্রজাতির এ মাছ আবিষ্কারের গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে বলে তারা দাবি করেন। তবে কতো সালে বা কতো তারিখে প্রকাশ পেয়েছে তার উল্লেখ নেই।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও মৎস্য গবেষক মো. নিয়ামুল নাসের উক্ত সংবাদপত্রের প্রতিবেদককে জানান, ‘বাংলাদেশের মাছের তালিকায় নতুন একটি নাম যুক্ত হলো, এটা অবশ্যই একটি সুসংবাদ। এর আগেও দেশের পাহাড়ি ও উপক‚লীয় এলাকায় বেশ কয়েকটি নতুন মাছের সন্ধান পাওয়ার কথাও জানান। তবে সুন্দরবনের ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই নতুন একটি ঘটনা বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, ১৯৮২ সালে আমি ফিরিঙ্গীবাজার এলাকায় এ ধরনের একটি পটকা মাছ ৪৫০ টাকায় স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। প্রথম আলোয় ছাপা মাছের ছবি থাকায় আমার পক্ষে সনাক্ত করতে সহজ হয়। আমার ক্রয়কৃত পটকা মাছটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. ক্বামার বানু ও অধ্যাপক কে এম নরুল হুদাকে হস্তান্তর করি। তাঁরা উক্ত পটকা মাছটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করেন। পরবর্তীতে আমি বিভাগে গিয়ে দেখে আসি। বিভাগ আমাকে ৪৫০ টাকার সম্মানিও দেয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত বিভাগে গয়াল ও মহিষের মাথা, কাঁকড়াসহ বেশকিছু প্রাণীর নমুনা সংরক্ষণের জন্য দিয়ে ছিলাম। ইতিমধ্যে প্রাণি বিজ্ঞানি জনাব হুদা ২০০০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। (আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসীব করুন) পরবর্তীতে ২০০৭/৮ সালে অধ্যাপক ড. ক্বামার বানু অবসরে যান। তিনি বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। কিন্তু দুঃখ এখানে আজ থেকে ৪০ বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে একটি নতুন প্রজাতির মাছ দেওয়ার পরও কেন তা সনাক্তকরণ করা হয় নি। যতদূর জানা যায় উক্ত বিভাগে বেশ কয়েকজন মৎস্য বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং আছেন। আমার ক্ষোভ ও দুঃখ এখানে আজ থেকে ৪৩ বছর আগেই মাছটি সনাক্ত করা যেত। দেশের নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ থাকা সত্তে¡ও উক্ত মাছটি চিহ্নিত করা গেল না। আমার দেওয়া সেম্পল এখনও উক্ত বিভাগে জমা থাকতে পারে। ্এতে করে এ কথাই প্রমাণ করে যে, দেশের বিজ্ঞানিরা যথাযথ জরিপ, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় মনোযোগী নন। তাঁরা তাদের কর্ম, সৃজনশীলতা, মেধা সঠিক কাজে প্রয়োগ করলে আমার দেয়া মাছটি নিয়ে গবেষণা করে একটি নতুন মাছ সনাক্তের সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। আমি যে পটকা মাছটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে দিয়েছিলাম তাঁর ওজন ছিল প্রায় সাতশত গ্রাম। তার পিঠে জালির মতো ছাপ ছিল। দুর্ভাগ্য এদেশের অধ্যাপক ও বিজ্ঞানীরা বিদেশি আর্থিক সহায়তা না পেলে গবেষণার ক্ষেত্রে আগ্রহী হন না।
পটকা মাছ নিয়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে। ছোট বয়সে জাল দিয়ে মাছ ধরার সময় পটকা মাছ (ছোট আকারের) পেলে তার মুখ দিয়ে বাতাস দিলে পেট ফুলে যেত। এছাড়াও বাজার থেকে লইট্যা ধেতুয়া আনলে তাতে পটকা মাছ পাওয়া যেত। হালে লইট্যা ধেতুয়ায় পটকা মাছ প্রায় দেখা যায় না। ২০০৬ সালে আমি কর্ম উপলক্ষে ধামরাই ছিলাম। ধামরাই, মানিকগঞ্জ তুলনামূলক নিচু এলাকা। সেখানে জলাশয়ে শীতের সময় পানি কমে গেলে এলাকার ছেলেরা পানি সেচ করে মাছ ধরে। একদিন লক্ষ্য করলাম পলিথিনে পানি দিয়ে জীবিত পটকা মাছ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। জানতে চাইলাম, বলল তারা পটকা মাছ খায়। আশ্চর্য হয়ে গেলামÑ এ কারণে যে, শৈশব থেকে জানি পটকা মাছ বিষাক্ত। খেলে মানুষ মারা যায়। আমার এক স্থানীয় ব্যবসায়ী বন্ধুকে বিষয়টি জানালাম। সে জানালো স্যার, আমি একদিন গ্রামে নিয়ে যাব এবং পটকা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়াব। খুব স্বাদ এই মাছ, নানা কারণে আর আমার হাবীব ভাইয়ের সাথে গ্রামে যাওয়া হয় নি। ব্যাংকের কাজের চাপে সে সুযোগ হয়ে উঠে নি।
আজও ভেবে আফসোস হয়Ñ একটি বৈচিত্র্যময় স্বাদ আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হলাম। মানুষের একটি জীবন। হায়, নানা কাজের ব্যস্ততায় তারা অনেক স্বাদ ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট এর তথ্য মতে দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় প্রাপ্ত মাছের প্রজাতির সংখ্যা ৪৪২টি। আর নদীতে থাকা স্বাদুপানির মোট মাছের সংখ্যা ২৬৫টি। পটকা জাতীয় মাছের মধ্যে স্বাদুপানিতে পাওয়া যায় ২টি প্রজাতি আর সমুদ্রে পাওয়া যায় ২৬টি প্রজাতি। এখন লিস্টে নতুন একটি যুক্ত হলো। পটকা মাছের ফাৎনায় বিষাক্ত উপাদান থাকায় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ পটকা মাছ খায় না। সংবাদপত্রে পটকা মাছ খেয়ে অনেক মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়। তবে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনে এটি একটি জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবার। এছাড়া এর সুপ অনেক দামিও বটে। বলা চলে এটা ধনীদের খাবার। একটি বিশেষ পদ্ধতিতে এই মাছ কেটে/প্রসেস করা হয়। সকলের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই পটকা মাছ খেতে সাবধান। মৃত্যুর হার দেশে বিদেশে কম নয়। এজন্য সতর্কতা প্রয়োজন। দেশের বিজ্ঞানিদের আরও গবেষণামুখী হওয়ার অনুরোধ জানাই।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)