সুখের ভাঙা সংসার

95

সুখের আসল ঠিকানা সংসার। সংসার নিয়ে সবাই সুখী হতে চায়। কেউ কেউ হলেও সবার কপালে সুখ জোটে না। সে দলের ক্যাপ্টেন মো. আবুল হাশেম। বাস করেন অস্ট্রেলিয়ায়। গাড়ি বাড়ি সবই আছে তার। দুই সন্তান আর বউ নিয়ে স্বাচ্ছন্দে দিন কাটলেও সুখ নেই। মা ভাই থাকেন বর্মায় এবং জ্ঞাতি গোষ্ঠীর সিংহভাগই বাস করছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আশ্রয় শিবিরে। নিজ দেশেও আশ্রয় শিবিরে রয়েছে অনেকে। সে-ও ১৯৯১ সালে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। তখন বয়স ছিল সতের। উঠতি বয়সের টগবগে যুবক। সুঠাম দেহের অধিকারী সুচতুর হাশেম সময় সুযোগে পাড়ি জমায় মালয়েশিয়ায়। চাকরি নেন সেখানে। যৌবনের বসন্তে জীবনে প্রেমের ফুল ফোটে। সেই ফুলের মালা পরিয়ে ষোড়শী মালয় যুবতিকে বিয়ে করেন। সুখের সংসার বাঁধেন। এক সময় পাড়ি জমান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে তার সংসারে আসে হিরের টুকরো দুই ছেলে। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে, অন্যজন অষ্টম শ্রেণিতে। ইচ্ছা থাকলেও নিজ দেশে হাশেম পড়াশুনা করতে পারেনি। ছেলেদের দিয়ে সে ইচ্ছা পূরণ করে নিচ্ছে। এ কথা বলতে গিয়ে তার মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠে। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখন সুখে আছি। ৬ নভে’২০১৮ রাতে বাসে কক্সবাজার থেকে কুমিল্লা যাচ্ছি। পাশের সিট আবুল হাশেমের। লম্বাদেহী সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। পরনে জিন্সের প্যান্ট, ফুল হাতা শার্ট, দেখতেও বেশ স্মার্ট। গাড়ি কিছুদূর এগুতেই আমার শীত শীত লাগে। এসি’র বাতাস থেকে বাঁচার জন্য সিট বদলাতে চাইলাম। বললাম, ভাই আপনি কি একটু এপাশে বসবেন। উত্তরে বলল, এসি’র সুইসটি বন্ধ করে দাও। এরপরও সমস্যা হলে এ পাশে আসতে পার। সুইস বন্ধ করে মুড অফে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। ধরে নিয়েছি ইবা কক্সবাজারের লোক। এরা সবাইকে তুমি বলে, যতবড় শিক্ষিতই হোক না কেন। কেউ কেউ আপনি বলার চেষ্টা করলেও পারে না। মুখ ফসকে তুমি বলে ফেলে। অবশ্য এটা এতটা দোষের কিছু নয়। প্রতিটি অঞ্চলেরই স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা বহন করে সে এলাকার মানুষ। একথা জানার পরও তুমি শব্দটা হজম করতে আমাদের একটু কষ্ট হয়। ঝিমিয়ে ঘুমিয়ে কখন যে চট্টগ্রাম চলে আসি টেরও পাইনি। নতুন ব্রিজের এ পাড়ে যখন টহল পুলিশ বাবার খোঁজে সবার ঘুম ভাঙিয়ে দেয় তখন টের পাই। ভ্রমণকারীদের জন্য এ এক বাড়তি ঝামেলা। কিন্তু চেক না করেই উপায় কি? এত চেকের পরও ইয়াবার থাবায় আমাদের যুবসমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টের বিষয় কী আর হতে পারে! যুবকদের বাঁচাতে না পারলে আমাদের বেঁেচ থাকার কী মূল্য আছে। টহল পুলিশ হাশেমকে জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠে, আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি। বাড়ি বর্মায়। কক্সবাজার কুতুপালং ক্যাম্পে এসেছিলাম মা ও স্বজনদের সাথে দেখা করতে। স্পষ্টভাষী হাশেমের কথা শুনে আমার ঘুমের ঘোর ভেঙে গেল। হরিণের মতো কান খাড়া করে তার কথা অনাহারীর মতো গিলতে লাগলাম। বর্মাইয়া শুনে টহল পুলিশ জেরা আরো বাড়িয়ে দিল। তার হাবভাব দেখে মনে হলো যেন বড় একটা শিকার পেয়েছে। তবে খতিয়ে দেখার পর আর কোনো ঝামেলা করেনি। পুলিশের জেরা শেষ হতে না হতেই হাশেম আমার জেরার তোপে পড়ে। সেখান থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত সবিরাম জেরা করে গেছি। উদ্দেশ্য তার কাছ থেকে কিছু জানা। প্রথম প্রথম একটু বিরক্তি ভাব দেখালেও শেষতক সখ্যতা গড়ে উঠে। কখনো হাসিমুখে, কখনো বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আমার সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যায়। সেই বর্মী জীবন থেকে অস্ট্রেলিয়া সবই অকপটে বলে যায়। বর্মায় গিয়ে মাকে দেখব সেটা সম্ভব নয়। তাই মাকে দেখার জন্য ১২ অক্টোবর ২০১৮ বাংলাদেশে আসি। তারপর ঢাকা থেকে বিমানে কক্সবাজার। দুই লাখ টাকা খরচ করে দালালের মাধ্যমে মাকে বর্মা থেকে বাংলাদেশে আনি। এভাবে সপ্তাহে বিশজন আসা যাওয়া করতে পারে। এ কাজে দালালের সাথে জড়িত দু’পাড়ের নিরাপত্তা বাহিনী। মাকে চিকিৎসা শেষে সেবা শুশ্রুষা করে আবার দুই লাখ টাকার বিনিময়ে বর্মায় পাঠিয়ে দিয়েছি। শুনেছি এখনো সেখানে নির্যাতন চলছে, তা কি ঠিক ? হ্যাঁ, চলছে। মায়ের ভাগ্যে যা আছে তা-ই হবে। হয়ত গুলিতে মারা যাবে, না হয় বাঁচবে। কী আর করার আছে। বাংলাদেশ তো আর আমাদের দেশ নয়। এখানে কয়দিন থাকবে। বর্মা আমাদের জন্মভূমি হলেও সরকার আমাদের নয়। তাই তাদের যা ইচ্ছা তা-ই করবে। আল্লাহ ছাড়া আমাদের তো আর কেউ নেই। জানি না মায়ের সাথে আর কোনো দিন দেখা হবে কি না। মা থাকেন রেঙ্গুনের শহর তলীর ছোট্ট একটি বাসায়। ঐ এলাকার বাড়িঘর পোড়ায়নি বর্মী বাহিনী। এখানে থাকলে হয়ত কিছুটা চিকিৎসা পেত, নির্ভয়ে দিন কাটাতে পারত, সেখানে বিনা চিকিৎসায় দুর্ভোগে দুশ্চিতায় মারা যাবে। বুক ফাঁটা ব্যথা বেরিয়ে আসে তার কথায়। তুষের আগুনের মতো ঘষে ঘষে জ্বলছে তার ভিতরটা। আগে সেখানে টাকা-পয়সা দিয়ে দুই এক ক্লাস পড়া যেত, এখন আর সেই সুযোগও নেই। মকতব মাদ্রাসা মসজিদ সবই গুঁড়িয়ে দিয়েছে। রাতের আধাঁরে লুকিয়ে লুকিয়ে ইবাদত করতে হয়। আগে কক্সবাজার এসে চিকিৎসা নিত। অনেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন মাদ্রাসায় পড়াশুনা করত। এখন আর সেই সুযোগও নেই। এখন থেকে একশত বছর আগে সেটা আমাদের মুল্লুক ছিল। আমাদের শাসন ছিল তিন’শ বছর। সাদা চামড়ার ইংরেজরাই আমাদের সমস্যায় ফেলে গেছে। তার কথার সত্যতা মিলে জাপান প্রবাসী কবি ও প্রাবন্ধিক ড. আরশাদ উল্লাহ’র লিখা প্রবন্ধের শিরোনামে ‘বার্মার নেতৃত্বে ছিল আরাকানী রোহিঙ্গা মুসলিমরা।’ সেখানে তিনি লিখেন, বার্মার মুসলিমরা কখনো স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নেয়নি। তারা বার্মায় শান্তিতে বসবাস করতে চেয়েছিল। ১৯৩৬ সালে তোলা একটি গ্রæপ ছবির মাধ্যমে তা তুলে ধরেন। ফটোটিতে পায়ের উপর পা তোলে যিনি বসে আছেন তিনি তৎকালীন অল বার্মা স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি আবদুর রশিদ। তিনি একজন রোহিঙ্গা। তার ডান পাশে অং সান, যিনি নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির বাবা। তিনি ছিলেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক। ডানে তৎকালীন বার্মার মুসলিম লীগের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক। জনাব আবদুর রশিদ বর্তমান বার্মার সংবিধানের একজন খসরা প্রণয়নকারী ছিলেন। ছবিটি সংযুক্ত করা হলো।
আবুল হাশেম বলেন, আমাদের জাতিগোষ্ঠীর চল্লিশ লাখ লোক রয়েছে। এখন বার্মায় আছে মাত্র ৬ লাখ, বাংলাদেশে ১৩ লাখ, মালয়েশিয়ায় ৬ লাখ, সৌদি আরবে ৫ লাখ। ইউরোপ আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই আমাদের লোকজন রয়েছে। বর্মায় আমার পরিবারের দু’শত লোক আছে। যাদের অন্তত: পঞ্চাশ জন অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাস করছে। আমরা যতটুকু জানি, বার্মার সরকার তোমাদের সেখানে থাকতে দিবে না। সেটা আমরাও জানি, একথা বলতে হাশেম একটুও দেরি করেনি। নিরুপায় হয়ে আমরাও চেষ্টা করছি বিভিন্ন দেশে তাদের সরিয়ে নিতে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো যারা বাংলাদেশে আছে। অন্যান্য দেশ থেকে সহজে সরিয়ে নেয়া গেলেও বাংলাদেশ থেকে পারা যায় না। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের অনেক সাহায্য করছে তবে কেউ কেউ টাকায় বিক্রি হয় এমন কথা বলতেও দ্বিধা করেনি সে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে টাকাওয়ালা আমাদের অনেক লোক রয়েছে এমনকি অনেক জনপ্রতিনিধিও আমাদের লোক। তারা তোমাদের সাহায্য করে না? করে, তাদের এগানাদের। আরসা নিয়ে নিয়ে কথা উঠতেই বলল, আমি এসবের তেমন কিছু জানি না। মিথ্যা বললে গুনাহ হবে না? তবে বিশ্ববাসী তো সবই জেনে গেছে। এই বলে বড় একটি টেব হাতে নিয়ে মালয়েশিয়া সৌদি আরবে প্রকাশিত খবর আমাকে শুনালেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে রোহিঙ্গাদের বার্মায় ফেরত পাঠানো হবে এ সংবাদ শুনে কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের একজন যুবক ফাঁসি দিয়ে মারা গেছে। এ সংবাদটি এতটাই তাকে বিচলিত করে যে, সে হায় হুতাশ করে প্রলাপ বকতে থাকে। বলতে থাকে জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে থেকে সরকার সরে গিয়ে তাড়াহুড়া করে তাদের পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। সরকার যদি এ যাত্রা আসতে না দিত সেটাই ভালো হতো। সেখানে থেকে গেলে হয়ত কোনো একটা ব্যবস্থা হতো। এ যাত্রা বাসে ঢাকায় যাচ্ছি বাংলাদেশের স্মৃতিপূর্ণ জায়গাগুলো এক নজরে দেখে যাবার জন্য। আগামীকাল শুক্রবার ঢাকায় বড় মসজিদে নামাজ পড়ার ইচ্ছা আছে। শুনেছি সেখানে অনেক মুসল্লি নামাজ পড়ে। কারো দোয়ায় যদি আল্লাহ আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে। বুঝতে পারলাম সে বায়তুল মুকাররম মসজিদের কথা বলছে। আমি তাকে যাবার রাস্তা বলে দিলাম এবং বললাম অসুবিধা হলে আমাকে মোবাইলে জানাবে। ধর্মের প্রতি তার অটল বিশ্বাসে আমি সত্যিই বিস্মিত হলাম। এত কষ্টের পরও কিন্তু তারা ধর্ম ত্যাগ করছে না। মুসলিম বলেই তারা এত নির্যাতিত হচ্ছে। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। নেতৃত্বহীন নিরীহ একটি জাতির পাশে শক্তভাবে দাঁড়াবার যেন আজ কেউ নেই। আমরা মানবতাবাদীরা কেবলই করুণা দেখাচ্ছি। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা পাওয়া কি তাদের অধিকার নয়?

লেখক : প্রাবন্ধিক