সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ বাড়াবাড়ি পর্যায়ের উত্তেজনা কাম্য নয়

30

সপ্তাহ যাবৎ বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও মিয়ানমার বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন পয়েন্টে নতুন করে সেনা সমাবেশ ঘটাচ্ছে। দৈনিক পূর্বদেশসহ জাতীয় ও স্থানীয় সহযোগী দৈনিকগুলো বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছে, সেদেশের বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সঙ্গে ব্যাপক আকারে নতুন সেনা সদস্যদের গতিবিধি নানা সন্দেহ ও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারেনা। একদিকে মিয়ানমার তাদের স্বদেশী রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতিগত নিধন ও নানা নির্যাতনের মাধ্যমে দেশ ত্যাগে বাধ্য করে আসছে কয়েকদশক ধরে। অপরদিকে মিয়ানমার বেশ কয়েকবছর ধরে সীমান্ত নিয়ম ও আন্তর্জাতিক বিধি বিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বারবার এ ধরনের বাড়াবাড়ি করে আসছে । ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে ঠিক এভাবে সেনা ও বিজিপি সদস্যদের রাখাইন রাজ্যে মোতায়েন করেছিল মিয়ানমার সরকার। অনুরূপভাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে গত একসপ্তাহ ধরে তিনটি পয়েন্টে সেনা মোতায়েন ঘটিয়ে তাদের সশস্ত্র টহল দৃশ্যমান করেছে। সীমান্তের অদূরে মিয়ানমারের সেনা টইল বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়ে এর ব্যাখ্যা চেয়ে বিজিবির (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) পক্ষে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির (বর্ডার গার্ড পুলিশ) কাছে পতাকা বৈঠকের আহ্বানও জানানো হয়েছে। একইসাথে গত রবিবার ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত অং কিউ মোয়েকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সন্দেহজনক সেনা তৎপরতা বন্ধ করে ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা সৃষ্টি করার পথ অবসানের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহবান জানানো হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ নিয়ে কোন ব্যাখ্যা মেলেনি। তবে পুরো সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সতর্কাবস্থান নিয়েছে। জোরদার করা হয়েছে নিয়মিত টহল। বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, বিনা উস্কানিতে সীমান্তে এভাবে সৈন্য মোতায়েন করা কারও পক্ষে সমর্থনযোগ্য নয়। সীমান্তে শান্তিরক্ষার্থে সন্দেহজনক এসব তৎপরতা বন্ধ করা দরকার। দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় কিছু ঘটানো বা স্থাপনা ইত্যাদি নির্মাণের পূর্বে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়ার চুক্তি রয়েছে। কিন্তু সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিপি ও সেনা সদস্যদের মোতায়েন করার পূর্বে বিজিবিকে অবহিত করেনি মিয়ানমার। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, জঙ্গি দমনের বাহানায় মিয়ানমার অভ্যন্তরে বিজিপি সদস্যরা প্রায় সময় ফাঁকা গুলি বর্ষণ করে থাকে। এবারও তাই হচ্ছে। মিয়ানমারে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি এবং রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গ্রপ আরসার ক্যাডাররা সে দেশের সীমান্তঘেঁষা এলাকায় অবস্থান করছে বলে সেদেশের সরকারের কাছে খবর রয়েছে। এছাড়া গত শুক্রবার আরাকান আর্মি (এএ) এবং আরসার সশস্ত্র ক্যাডাররা রাখাইনের বুচিদং এলাকার লাউয়াদং পাহাড়ের পাদদেশ থেকে গুলি চালিয়েছে দেশটির বিজিপির ওপর। এতে কতজন হতাহত হয়েছে জানা না গেলেও সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহী জঙ্গিদের অবস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে ধারণায় মিয়ানমার সরকার সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা মিলেছে। এছাড়া আরেকটি ধারণা পাওয়া গেছে, সেটি হচ্ছে, সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে পুরনো সৈন্যদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। নিয়োগ দেয়া হচ্ছে নতুন সৈন্যদের। পুরনোদের মধ্য থেকে ইতোমধ্যে দুজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ জানিয়েছে এই বলেÑ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট গভীর রাতের পর রাখাইন রাজ্যে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর বর্বর অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। বিষয়টি মিয়ানমার সরকারকে বিব্রত করেছে। পুরনো সৈন্যদের মধ্যে থেকে আর কেউ যাতে দেশ ছাড়তে না পারে সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। আরেকটি সম্ভাব্য কারণ বেরিয়ে এসেছে সেটি হচ্ছে-রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিধন ও গণহত্যার বিষয়ে গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে যে মামলা হয়েছে তার বিচার কার্যক্রম বাংলাদেশে চালানোর জন্য ২ সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে এ ধরনের আদালত পরিচালনার ব্যাপারে কক্সবাজারের একটি সংস্থার পক্ষ থেকে সম্ভাব্যতাও যাচাই করা হচ্ছে বলে খবর রয়েছে। এতে করে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাক্ষী দেয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে যা বিচার কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করবে। এ নিয়েও মিয়ানমার সরকার উদ্বিগ্ন। আরেকটি সূত্র বলেছে, রাখাইন রাজ্যে বিভিন্ন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বসবাস করা গ্রামের নাম দেশটির মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। এর সূত্র ধরে শুক্রবার বিকেলে রোহিঙ্গা সশস্ত্র জঙ্গি গ্রুপ আরসার ক্যাডার এবং আরাকান আর্মির সদস্যরা বুচিদংয়ের লাউয়াদং এলাকায় বিজিপি ও সেনাবাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। এতে মিয়ানমারের কয়েক সেনা সদস্য হতাহত হয়েছে। এ কারণে হয়ত মিয়ানমার সীমান্তে সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে বিজিপি ও সেনাবাহিনী। অন্য একটি পক্ষ সন্দেহ করছে- সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে তারা তাদের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি জানান দিতে চায় বলে ওপারের সূত্রগুলো ধারণা দিয়েছে। কারণ যাই হোক মিয়ানমার যে প্রক্রিয়ায় তাদের নিরাপদ বা নিরাপত্তার কথা ভাবছে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়, বাংলাদেশও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্যও নয়। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। প্রয়োজনে দেশটি তাদের বাড়াবাড়ি অব্যাহত রাখলে বাংলাদেশ কঠিন অবস্থানে যাবে-সন্দেহ নেই। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে মিয়ানমারের সকল অনৈতিক আবদারের জবাব দিতে হবে।