সীতাকুন্ডের শিব চতুর্দশী মেলায় পুণ্যার্থীর ঢল

92

সীতাকুন্ডের ঐতিহ্যবাহি শিব চতুর্দশী মেলায় ব্যাপক পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে। সোমবার ভোরের আলো ফোটার আগেই চন্দ্রনাথ তীর্থে যাত্রা শুরু করেন কয়েক হাজার ভক্ত। প্রায় ৩শ’ বছরের প্রাচীন এ মেলা চলবে বুধবার (৬ মার্চ) পর্যন্ত। মেলায় যোগ দিচ্ছেন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাধু-সন্ন্যাসী ও দর্শনার্থীরা।
সোমবার বিকাল ৫টা ৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড থেকে শিব চতুর্দশী তিথি শুরু হয়। আজ মঙলবার সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর্যন্ত এই তিথিতে ডাবের জল ও দুধ দিয়ে শিবস্নান করাবেন ভক্তরা।
এদিকে মেলায় অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পুণ্যার্থীরা। সোমবার বিকালে ধুলাবালিতে সুনিল সোহান (৬৫) নামে এক তীর্থযাত্রী শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত জয়ে মৃত্যুবরণ করেন বলে জানান তার আত্মীয়রা। সুনিল হবিগঞ্জের মাধবপুর জগদিশপুর চা বাগান এলাকার মৃত মোহল লাল সোহানের পুত্র। সীতাকুন্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক রানা চৌধুরী।
অপরদিকে মেলার প্রাঙ্গণে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে তীর্থ যাত্রীরা সর্বস্ব হারাচ্ছেন। সীতাকুন্ড পুলিশ প্রশাসন জানিয়েছে, ছিনতাইয়ের অভিযোগে রবিবার ২ ছিনতাইকারীকে আটক করা হয়েছে। তারা হলো-ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ এলাকার ছাদেক মিয়ার পুত্র আল আমিন (২৫) ও একই এলাকার আলী আকবরের পুত্র খোকন (২৬)।
মেলায় আসা আনোয়ারার কেশব দাশ (৭২) অভিযোগ করেন,‘এই মেলায় বাবার সাথে ১৬ বছর বয়সে এসেছি। বিয়ের পর বউ-বাচ্চাকে নিয়ে এসেছিলাম। এখন বৃদ্ধ বয়সে আবার এলাম। সেই ১৬ বছর বয়সে যেমন দেখেছি, এখন তেমন। মেলায় লক্ষ লক্ষ টাকার হিসাব-কিতাব থাকলেও, চন্দ্রনাথ ধামে যাবার পথের সিঁড়িগুলো আর সংস্কার হয় না। সদিচ্ছা থাকলে এখানে ‘ক্যাবল কার’ স্থাপন করা যেতো। স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি না থাকায় বেড়েছে ছিনতাইকালীদের দৌরাত্ম্য। জায়গা-সম্পত্তি দেখভাল করার জন্য স্রাইন কমিটি থাকলেও এখানকার প্রচুর সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে।’
তবে মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক পলাশ চৌধুরী জানিয়েছেন, তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে চন্দ্রনাথ মন্দির পর্যন্ত আলোকসজ্জা, জল সরবরাহ, চিকিৎসা সেবা ও আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিব সম্পর্কে জানতে চাইলে শাস্ত্র বিশারদ পন্ডিত অমল চক্রবর্তী বলেন, ‘যার মধ্যে সবকিছু লয়প্রাপ্ত হয় তাকে লিঙ্গ বলে? আকাশকে লিঙ্গ বলা হয় কারণ সবকিছু শূন্যে বা আকাশে লয় হয়? তাই বৈদিক শাস্ত্রের বাণী-আকাশং লিঙ্গমিত্যাহুঃ? আকাশ সর্বব্যাপী বলে লিঙ্গও সর্বব্যাপী? এটি কোনও মানব লিঙ্গ নয়। মানবলিঙ্গ নিম্নমুখি কিন্তু এ লিঙ্গ ঊর্ধ্বমুখি হয়ে অবস্থান করছে? প্রলয়ের সময় সবকিছু আকাশে বা লিঙ্গেই মিশে যাবে অর্থাৎ লিঙ্গই সব গ্রাস করবে? তাই লিঙ্গরূপী শিবকে আমরা সংহারের দেবতা বলি? একমাত্র কুরুচি সম্পন্ন লোকেরাই লিঙ্গের অর্থ না জেনে একে কামজ দৃষ্টিতে বিচার করে মহাপাপভাগী হয়? যদি কামজ ব্যাপার হতো তাহলে কামজয়ী মহাজ্ঞানী ঋষিরা এ পূজার বিধান কখনো দিতেন না?’
সীতাকুন্ড স্রাইন কমিটির উদ্যোগে মোহন্ত আস্তানায় প্রতিদিন চলছে বৈদিক সম্মেলন। কমিটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. চন্দন দাশ বলেন, ¯্রাইন কমিটির প্রশাসক হচ্ছেন চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজ মো. ইসমাইল হোসেন। গত দুই বছর ধরে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করে আসছি।
সোমবার সকালে বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শিবলোক প্রাপ্তির আশায় পুণ্যার্থীদের চন্দ্রনাথ দর্শনে যেতে দেখা গেছে। ‘হর হর মহাদেব’, ‘জয় শিবসম্ভু’ ধনি দিয়ে আবার কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে চলছেন শিবদর্শনে। সমতল থেকে প্রায় ১২শ’ ফুট উপরে পাহাড় চূড়ায় প্রথমে স্বয়ম্ভুনাথ, এরপর বীরুপাক্ষ ও সর্বশেষ চন্দ্রনাথ মন্দিরের অবস্থান।
এই তিথিতে বিবাহিত নারীরা স্বামী ও পরিবারের মঙ্গল কামনায় উপোস থেকে ব্রত পালন করছেন। এরপর অমাবস্যা তিথিতে ব্যাসকুন্ডে পূর্বপুরুষের আত্মার সদগতি কামনায় স্নান-তর্পণ ও পিন্ডদান করবেন পুণ্যপ্রত্যাশীরা।
শিব চতুর্দশী মেলাকে ঘিরে কয়েকটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যাত্রীরা মন্দির সড়ক হয়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে পারেন কিংবা বটতলী কালীবাড়ির সামনে থেকে চাঁদের গাড়িতে করে ইকোপার্ক হয়ে চন্দ্রনাথ দর্শন করে ওই পথে ফিরতে পারেন।
সীতাকুন্ড রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মতিলাল বড়ুয়া জানান, সীতাকুন্ড স্টেশনে আন্তঃনগর ও ঢাকার মেইল ট্রেনসহ সব ট্রেন যাত্রা বিরতি করছে।

সীতাকুন্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেলওয়ার হোসেন জানান, মেলায় তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণে র‌্যাবের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়েছে। পুলিশ, বিজিবি, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও আনসার বাহিনীর সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করছে।