সি.এ.এ. বা নাগরিকত্ব আইন ভারতের প্রতিবেশীদের বিরক্তির উদ্রেক করেছে

746

উপরোক্ত শিরোনামে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক মহেন্দ্র ভেড় যিনি ‘কমনওয়েলথ জার্র্নালিস্ট এসোসিয়েশনের’ সভাপতি এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক ইংরেজি সংবাদ-পত্রে উক্ত শিরোনামে ভারতের লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় (সি.এ.এ) নামে যে আইন পাশ করে শুধু মুসলমান ছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, শিখ্্, জৈন ইত্যাদি’দেরকে নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন অনুমোদিত হওয়ার ব্যাপারে লেখার বাংলা অনুবাদ “ঝড়ঁঃয অংরধ গড়হরঃড়ৎ” পত্রিকার লেখাটি বের হয়েছে।
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন যাকে সংক্ষেপে (সি.এ.এ.) বলা হয় এবং ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন (এন.আর. সি.) ভারতীয় লোক সভায় এবং রাজ্য সভায় অনুমোদিত হওয়ার পর ভারত সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী বাংলাদেশের ভীষণ বিরক্তির উদ্রেক করেছে। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন এবং ভারতের উত্তরপূর্ব সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতা চিরতরে অবসান করার ব্যাপারে ভারতকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করছেন। তারপরও ভারতের সৃষ্ট উত্তেজনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি আমি ঢাকায় সফরে গেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন উচ্চপদস্থ উপদেষ্টা আমাকে উপরোক্ত কথা বলেন। আপনার চোখ এবং কান যদি খোলা থাকে তাহলে অনুভব করতে এবং বুঝতেই পারবেন সেখানে এব্যাপারে যথেষ্ট উত্তেজনা বিরাজ করছে। সংবাদ পত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের রিপোর্ট এবং প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে ভারতের কার্যাবলীর বিবরণ দিয়ে অহ-রহ ভুরি ভুরি সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের পর-রাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন তাঁর নয়াদিল্লী সফর বাতিল করার কয়েকদিন পর অভিযোগ করেছেন, ভারতীয় নাগরিকরা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে খাদ্য এবং কাজের আশায়, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হওয়ার পর থেকে। রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগরা ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের গুরুত্ব দেয় এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ভারত সম্পর্কে সংশয়ও দূর করতে প্রয়াস পায়। কিন্তু বিরোধী দল বিশেষ করে বি.এন.পি. বা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যখন বলেন, ‘সি.এ.এ. বাংলাদেশের মানুষের জন্য মরণ বা বাঁচার বিষয়।’ তখন ইহা ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের জন্য ভয়াবহ চাপের সৃষ্টি করে। ভারতের নেতৃত্ব ইহা হয়তো উপলব্ধি করতে পারেনা বা ইহাকে গ্রাহ্যই করেনা। কিন্তু ইহা ভারতের বিরুদ্ধে আগেও এবং এখনও বিরাট ফ্যাক্টর হিসাবে বিরাজ করছে। ইহাতে ভারত বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মেঘালয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ফলে বাংলাদেশি নাগরিকত্বের টানাবিল ল্যান্ড পোর্টে অভিবাসন সুবিধাদি স্থগিত রাখা হয়েছে। ভারতীয় হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলীকে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে এই ব্যাপারে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে মনে করে ভারত বাংলাদেশের উদ্বেগের ব্যাপারে ওয়কিফহাল নয়। যদিও বৃটিশ আমল থেকে বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পর্কে ভারতের উদ্বাস্তু হওয়ার অভিযোগ এবং বাংলাদেশের কিছু সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার আমন্ত্রণ বাংলাদেশের মুখের উপর চড় দেওয়ার সমতুল্য এবং ইহা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাতস্বরূপ। বৎসরের পর বৎসর ধরে ভারতের আত্মত্যাগ এবং সুনাম বিপন্ন হয়ে যাবে। এখন বাংলাদেশ স্বভাবতই মনে করছে ভারত বড়-ভাই সুলভ আচরণ শুরু করছে এবং বাংলাদেশের কথায় অকাট্য যুক্তি রয়েছে।
মানুষ নিরাপদ বাসস্থান এবং জীবিকার অন্বেষণে বর্ডার পার হয়। ইহা সম্পূর্ণ ভাবে স্বীকার করলেও বাংলাদেশিরা আইনতঃ বা বে-আইনীভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। এর আগে এসব অনুপ্রবেশকারীদের কিভাবে অনুসন্ধান করে বের করা হতো?
১৯৯০ দশকে তীব্র প্রতিবাদের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী (তদানন্তীন) নরাসিমারাও অনুপ্রবেশকারী অনুসন্ধান করে বের করার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর স্ব-রাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শংরাও চেবন। অনেক অনুসন্ধান করে তিনি বহিরাগতদের বের করেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে তিনি যে রিপোর্ট দেন তাতে জানা যায় যে তখন মাত্র ৬০০ বহিরাগত বের করা হয়েছিল। যাদেরকে ভারত থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, পরবর্তী সময়ে জানা যায় কিছুদিনের মধ্যে তারা আবার ভারতে চলে এসেছিল। সবার কাছে ইহা জানা যে, কত সহজে ভারতে রেশন কার্ড এবং ভোটের কার্ড সংগ্রহ করা যায়। আসলে সি.এ.এ.শুধু বাংলাদেশের জন্য বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে নাই। বরং ভারতের সমস্ত প্রতিবেশী দেশসমূহে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বৈরি পাকিস্তানে নয়, বন্ধু প্রতীম আফগানিস্তানে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সবাই নীরবে অস্থিত্বের জন্য লড়ছে কারণ এই নীতির দ্বারা সবাই ভারতের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
কোন দেশ সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সমালোচনা করা পছন্দ করেনা। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দেশান্তরিতদের উইপোকারূপে আখ্যায়িত করা নিশ্চয়ই প্রতিবেশীদের পছন্দ হবেনা। আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার জন্য বা বৈশ্বিক শক্তিরূপে গড়ে উঠতে হলে এসব আঞ্চলিক দেশগুলি অবশ্যই সাথে থাকতে হবে তথা তাদের আন্তরিক সমর্থন লাগবে। দক্ষিণ-এশিয়ার ধর্মের ভিত্তিতে জন-সংখ্যা নির্ণয় করে এবং মুসলমান ছাড়া বাকী সবাইকে আমন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন পড়েনা। কে ভারতকে এই অধিকার এবং দায়িত্ব দিল যখন ভারতের মুসলমান এবং হিন্দু দলিতরা এবং উপজাতীয়রা (নক্সালের নামে) আক্রমণের টার্গেটে পরিণত হলো এবং তাদেরকে ভীতির মধ্যে বেঁেচ থাকতে হচ্ছে লক্ষ লক্ষ হিন্দু তাদের পছন্দনীয় দেশে বাস করে এবং সেখানে নিজেদের অবস্থা সমন্বয়ে করে নেন। ভারতে বসবাসের জন্য যারা আবেদন করে তাদের কথা বিবেচনা করতে পারে, কিন্তু ভারতে আসার আমন্ত্রণ করার অর্থ প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌমত্ব উপর হস্তক্ষেপ করা। আফগানিস্তানে এবং পাকিস্তানে কয়েক হাজার হিন্দু এবং শিখ আছে বাকিগুলি অনেক আগেই ভারতে বাস করছেন এবং অনেক বৎসর ধরে নাগরিত্ব পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ঐসব দেশে জৈন ধর্মের লোক আছে। পাকিস্তানে কয়েক শত পার্সি আছে তারা কি ভারতের কাছে অভিযোগ করেছে না ভারতের নাগরিকত্ব চেয়েছে? ধরে নেওয়া গেল সেসব ধর্মের লোক ভারতে আনার ব্যাপারে আইন করা হলো ভারতীয় সরকারকে তাদেরকে ভারতে নিয়ে আসার জন্য আইন করার ক্ষমতা কে দিয়েছে? ভারত কি অন্যান্য দেশের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা পেয়েছে? এবং তাদের সাথে শান্তিতে বাস করতে ভারত কি আশা করে?
পাকিস্তানের শিক্ষা থেকে আমাদেরকে শিখতে হবে। পাকিস্তান যতবার মুসলিম উন্মার পক্ষে কথা বলতে চেষ্টা করেছে প্রত্যেকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রয়াত পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক যখনই ইসলামের সংকটের ডাক দিয়েছিলেন তখনই ভোগান্তি হয়েছিল। বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খাঁনকে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এক ইসলামী সম্মেলনে উপস্থিত না থাকতে বাধ্য করা হয়েছে, অথচ এই সম্মেলনের আয়োজন করতে তাঁর জোরালে ভূমিকা এবং শ্রম ছিল। সাউদি আরব তাঁকে এই সম্মেলনে উপস্থিত না থাকার জন্য বাধ্য করেছে এবং এই সম্মেলনে যোগদান করলে সাউদীর দেওয়া ঋণ স্থগিত করার হুমকী দেন। এমন কি ইমরান খাঁন সাউদী প্রতিদ্ব›িদ্বদের (তুরস্ক, কাতার এবং ইরান) সাথে মাখামাখির কারণে সাউদী আরব পাকিস্তানকে ঋণ দেওয়া বন্ধ করার পর্যন্ত হুমকি দিয়েছেন। কাজেই ধর্মের রাজনীতি বিশ্বে খুব একটা টেকসই হতে দেখা যায় না।
ভারত হিন্দুত্বের পক্ষে যা বলতে চায় তা হলো ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়ে হিন্দুদের উপর জুলুম ও অত্যাচারের বিষয়। এখন কি দেশ বিভাগের ৭ দশক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর ইতিহাস কি নুতনভাবে লেখা সম্ভব হবে; কে উৎপীড়িত এবং কে উৎপীড়িক? কিন্তু একথা সত্য দেশ বিভাগের সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দু, মুসলমান এবং শিখ্্্ স্ব-স্ব দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল।
সে ভয়াবহ অতীতের কথা উঠানো কি যথাযোগ্য হবে? খেলার ভাষায় গেলে এই ক্ষেত্রে ভারত নিজে নিজে গোল খাবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বহু কষ্টকর প্রচেষ্টার পর গালফ এর মুসলিম রাষ্ট্রগুলির সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। সাউদী আরব ভারতে যথেষ্ট পুঁজি বিনিয়োগের জন্য আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং তার জন্য তোড়জোড়ও শুরু হয়ে গেছে। ইউ.এ.ই’তে ভারতীয় মুসলিমদের সাথে মুদির একত্রে ফটো তোলা; সবকিছু বাদ দিয়ে তিনি এখন ভিন্ন পথে চলতে চান কেন? ভারত যদি মনে করে, তার রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য সে যেকোন দেশের বিরক্তির উদ্রেক করতে সক্ষম এবং তবুও সে ঐসব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে তা হবে ভারতের জন্য মহা ভুল পদক্ষেপ। তাঁর সরকারকে উল্টো গিয়ারে চালানো হচ্ছে।
লেখক : কলামিস্ট