সিল করা গুদামেই প্যাকেটজাত হচ্ছে জালিয়াতির খাদ্যপণ্য

63

একটি সরকারি ব্যাংকের ঋণ খেলাপির অভিযোগে কক্সবাজার সদর ঝিলংজা বিসিক এলাকায় প্রায় ২০ বছর আগে সিলগালা করা হয় কালু কোম্পানি নামের এক ব্যক্তির মালিকানাধীন মিল। দীর্ঘদিন এটি অনেকটা ‘পরিত্যক্ত গুদাম’ হিসেবে ছিল। সম্প্রতি এই পরিত্যক্ত গুদামটি আবার সচল হতে দেখা যায়। যা ঋণদাতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষও হয়তো জানে না। সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে গুদামের ভেতরে ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক প্যাকেটজাতের কাজ করতে দেখা গেছে। কোন ধরনের মালামাল প্যাকেটজাত করছে- তা জানতে গুদামের ভেতরে ঢুকতে চাইলে বারণ করে, ছবি তুলতে বাধা দেয় বাইরে চেয়ার নিয়ে বসে থাকা এক ব্যক্তি। তিনি নিজের নাম সজীব পরিচয় দিয়ে বলেন, এখানে ‘ময়দা’ প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। তবে ভেতরে ঢোকা যাবে না। ‘বস’-এর নিষেধ আছে। ছবি তুলবেন না। কি সমস্যা বলুন। উদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় কথাগুলো বলছিল ম্যানেজার পরিচয়ধারী সজীব।
প্যাকেটজাত করে কোথায় নেয়া হবে? জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কক্সবাজার লালদীঘির পাড়স্থ ইডেন গার্ডেনেও তাদের অফিস আছে। এর চেয়ে আমি বেশি কিছু জানি না। সংশ্লিষ্ট কারো নাম, মোবাইল নাম্বার চাইলে অপারগতা প্রকাশ করে সজীব। এরপর সে গুদামে কর্মরত শ্রমিকদের দ্রুত মিল ত্যাগ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে নিজেই সটকে পড়ে। শ্রমিকরাও গুদামের দরজায় তালা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। গুদাম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কথা হয় আবুল কালাম, আকতার, করিম, আলম, আকবর, কুরবান আলী, কাদেরসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিকের সাথে। তারা জানিয়েছে, অনেকদিন ধরে শ্রমিক হিসেবে তারা দৈনিক মজুরিতে কাজ করছে। গাড়িতে করে প্রতিদিন তাদের প্যাকেটজাত করা চালডালগুলো নিয়ে যাওয়া হয়। তবে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়? তা তারা জানে না বলে উত্তর দেয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মো. রফিক নামের এক ব্যক্তি গুদামটির পুরো নিয়ন্ত্রক। তিনি গুদামটি ভাড়া নিয়েছেন।
তার পার্টনার হিসেবে রয়েছেন-কক্সবাজার শহরের খুরুশকুল রোডের সাগর এন্টারপ্রাইজের মালিক শ্রীমন্ত পাল সাগর এবং চাল বাজারের এসবি এন্টারপ্রাইজের মালিক বুলবুল তালুকদার। তিনজনের এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিম্নমানের চাল, ডাল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। জানা গেছে, রফিক-সাগর-বুলবুল সিন্ডিকেট ডব্লিউএফপির খাদ্য সরবরাহ নিয়ে এতোটাই সূক্ষ ও পেশাদারী কায়দায় দুর্নীতি করেছে তা অকল্পনীয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ডবিøউএফপির নিযুক্ত এক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকার রাজারবাগের জহুরা কামাল ট্রেডিংয়ের মালিক জনৈক টিপু। ঠিকাদার জহুরা কামাল ট্রেডিং অবৈধভাবে তার সাব-কন্ট্রাক্ট দেয় রফিক-সাগর-বুলবুল সিন্ডিকেটকে। তারা ঢাকার জহুরা-কামাল ট্রেডিংয়ের মালিক টিপুর কাছ থেকে বিরাট অংকের টাকা দিয়ে ডব্লিউএফপিকে চাল-ডাল সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে। চাল এবং ডালই হলো রোহিঙ্গাদের প্রধান খাদ্য উপকরণ। সাগর-বুলবুল সিন্ডিকেট বহুমুখী খাদ্য দুর্নীতিতে জড়িত। যা ইতিমধ্যে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কয়েকদিনে বিজিবি কর্তৃক ডব্লিউএফপির ৪৫ হাজার ডালসহ কাভার্ডভ্যান উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত এসব ডাল রফিক-সাগর-বুলবুল সিন্ডিকেটের বলে দাবি করেছেন অনেক ব্যবসায়ী। এরা এতোটা দুর্নীতিগ্রস্থ হয়েছে যে, রাতারাতি এরা আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছে। এরা সরকারি খাদ্য গুদামের অসাধু কর্তাদের সহযোগী হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে সরকার কর্তৃক কেনা ভালো মানের চাল বাইরে বিক্রি করে দেয়। তার বদলে নিম্নমানের এবং অনেক সময় পঁচা চাল সরকারি গুদামে জমা করে দেয়।
এদিকে রোহিঙ্গাদের চাল-ডাল সরবরাহের দুর্নীতি গোপনে সম্পাদনের জন্য এই সাগর-বুলবুল বিসিক এলাকার একটি পরিত্যক্ত গুদামকে বেছে নেয়। যেটি বর্তমানে ব্যাংকের মালিকানাধীন রয়েছে। এদিকে রফিক-সাগর-বুলবুল সিন্ডিকেট উখিয়া-টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করে দেয়া চাল-ডাল নামমাত্র দামে সংগ্রহ করে। রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে সস্তায় চাল ডাল কেনার জন্য প্রতিটি ক্যাম্পে নিযুক্ত আছে সিন্ডিকেটের লোকজন। এসব চাল-ডাল জমা করা হয় বিসিকের কালু কোম্পানির সেই পরিত্যক্ত গুদামে। সেখানে ইউএস এইড এর ছাপানো বস্তায় এসব চাল ডাল প্যাকেটজাত করে।
এ ব্যাপারে সাগর এন্টারপ্রাইজের মালিক শ্রীমন্ত পাল সাগর গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি নিজেকে ডবিøউএফপির তালিকাভুক্ত ঠিকাদার বলে দাবী করেন। তিনি তার অপকর্ম স্বীকার করে বলেন, দুই টাকা বেশি লাভ করতে হলে এদিক-সেদিক করতে হয়। দাবি উঠেছে, সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা নিয়ে দুর্নীতির মূল হোতা কক্সবাজার শহরের খুরুশকূল রোডের সাগর এন্টারপ্রাইজের মালিক শ্রীমন্ত পাল সাগর এবং চাল বাজারের এসবি এন্টারপ্রাইজের মালিক বুলবুল তালুকদারকে আইনের আওতায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার দাবী জানিয়েছে। সিলগালা করা গুদামে কিভাবে কাজ করেন? বুলবুল-সাগরের সাথে আপনার কোন ধরনের সম্পর্ক- মুঠোফোনে জানতে চাইলে মো. রফিক কোন সদুত্তর দেননি।