সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে দেশের ঔষধের বাজার, ঠকছেন ক্রেতারা

20

লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা-মানুষের ন্যায্য অধিকার। এগুলো মানুষের বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদানও বটে। আর স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। সুস্বাস্থ্য রক্ষার্থে প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, ডাক্তার ও ঔষধ। আর ঔষধই অসুস্থতার একমাত্র নিয়ামক। বর্তমানে বাংলাদেশে ঔষধ শিল্প অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক ভালো সময় পার করছে। বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প দেশের প্রয়োজনীয় সকল ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন করতে সমর্থ। বাংলাদেশে বর্তমানে ২৫৭টি কারখানায় প্রায় ২৪,০০০ ব্র্যান্ডের ঔষধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ২৫,০০০ কোটি টাকার ঔষধ ও কাঁচামাল তৈরি করছে। এতে করে ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ ঔষধের চাহিদা পূরণ করছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। তাছাড়াও, দেশের অর্থনীতিতে রাখছে বিরাট ভূমিকা। বাংলাদেশের উৎপাদিত ঔষধ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ১৪৫টি দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাংলাদেশের উৎপাদিত ঔষধের চাহিদা ও ব্যবহার বিশ্ববাজারে বেড়েই চলেছে। এত সব সুখবরের মধ্যে খারাপ খবরটা হলো, বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশে উৎপাদিত ঔষধের চাহিদা বেড়ে চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের ঔষধের বাজারে। দেশীয় বাজারে উৎপাদিত হচ্ছে ভেজাল ও নকল ঔষধ, যার ফলে ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে ঔষধ শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভেজাল ও নকল ঔষধ এই শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনি সংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ঔষধের বার্ষিক বিক্রি প্রায় ১.৫ হাজার কোটি টাকার উপর। বিরাট অংকের ভেজাল ঔষধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায় বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ঔষধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি। এইসব ভেজাল ও নকল ঔষধ বাণিজ্যের ফলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে। ভেজাল ঔষধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভেজাল ঔষধের বিক্রয় মানেই ভোক্তার সাথে প্রতারণা। যার ফলে ভোক্তার আর্থিক ক্ষতি, মানসিক বিড়ম্বনা এবং পণ্যের বদলে কিনে নিচ্ছেন অনর্থক দুর্ভোগ। ভেজাল ও নকল ঔষধ ব্যবহারের ফলে নিজেদের অজান্তেই সুস্থতার বদলে উল্টো দীর্ঘায়িত করছে অসুস্থতা। ভেজাল ও নকল ঔষধকে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ‘মরণ ফাঁদ’ বললেও ভুল হবে না। দিনদিন ওষুধের বাজার ক্রমশ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। দেশজুড়ে ওষুধ বাণিজ্যে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ওষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে নির্ধারিত মূল্যের কয়েকগুণ বেশি দাম রাখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওষুধের মূল্য নিয়ে নৈরাজ্য দীর্ঘদিনের। ২০০৮ সালে অপরিহার্য ওষুধের ক্যাটাগরিতে সরকার যে ১১৭টি ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেই ওষুধগুলোর মূল্যেরই কোনো ঠিক নেই। একেক কোম্পানি একেক দাম রাখছে। আগের মতোই বিভিন্ন অজুহাতে যেমন খুশি মূল্য রাখছে ফার্মেসিগুলো। এই নির্ধারিত মূল্যের বাইরে শত শত ওষুধের যথেচ্ছ দাম রাখা হচ্ছে। এই নৈরাজ্যের বাজারে ওষুধ কোম্পানি আর বিক্রেতা ফার্মেসিগুলো মিলে ভয়াবহ অরাজকতায় নেমেছে। তাই নিয়ন্ত্রণহীন দেশের ওষুধের বাজার। ওষুধের প্যাকেটে খুচরা মূল্য উল্লেখ থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই দামে বিক্রি হয় না। ১২ টাকার ইনজেকশন ৮শ’ এবং ৬০ টাকার ওষুধ ১৯শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশব্যাপী বৈধ-অবৈধ প্রায় ২ লাখ খুচরা ব্যবসায়ী ইচ্ছেমতো দামে ওষুধ বিক্রি করছেন। তাদের এ কাজে সহায়তা করেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিক্রয় প্রতিনিধিরা। এই চক্র দেশের সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যসন্ত্রাস চালালেও নির্বিকার সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি এবং বিপণন খরচ মেটাতে সময়-অসময় দাম বাড়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলো। তবে দোকানিরা দাম বাড়িয়ে থাকলে বিষয়টি প্রশাসনের জানা নেই। এমনকি তারা কোনো অভিযোগও পায়নি। তিনি জানান, প্রশাসনের কাজ চালাতে প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় দেশের সব ওষুধের দোকানের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব হয় না। দেশের ঔষধ বাজারে ভেজাল এবং নকল ঔষধের বাণিজ্য কতটা শক্ত হাতে দমন করছে প্রশাসন, এই বিষয়টি এখন মুখ্য। দেশের মোট চাহিদার আনুমানিক ২০% ভেজাল ঔষধ উৎপাদিত হচ্ছে। প্রশাসনের পর্যাপ্ত তদারকি থাকলে উক্ত ২০% ভেজাল ঔষধ উৎপাদন ও বাজারজাত সম্ভব হতো না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঔষধ শিল্পের অনিয়ম বন্ধ করার মত তেমন কোনো বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভেজাল ও নকল ঔষধ বন্ধের জন্য প্রশাসন মাঝে মাঝে কিছু অভিযান পরিচালনা করে, যা তেমন কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট মানহীন ঔষধ তৈরির দায়ে কিছু কোম্পানির ঔষধ উৎপাদন বন্ধ রেখেছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালতের ভাষ্যমতে, এসব নোংরা বাণিজ্যতে দেশের প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তিবর্গ যুক্ত রয়েছেন। এসব ভেজাল ও নকল ঔষধ বাণিজ্যের শুরু কখন থেকে তা বলা মুশকিল কিন্তু শেষটা বলা সম্ভব, যদি প্রশাসন শক্ত হাতে দমন করে অসুস্থ ঔষধ বাণিজ্যকে। ভেজাল ঔষধ বাণিজ্য মূলত সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রশাসন এইসব সিন্ডিকেটকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারলে ভেজাল ও নকল ঔষধের বিপণন ও বাণিজ্য অনেকটাই কমে আসবে। ঔষধ বাজারে নিয়মিত মনিটরিং সম্ভব হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা খোলা বাজারে ভোক্তার কাছে ভেজাল ঔষধ বিক্রি করতে পারত না। এসবের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দরকার উৎপাদিত ঔষধের কারখানায় নজর রাখা যেন ভেজাল ও নকল ঔষধ উৎপাদন না হয়। ফার্মেসিগুলোতে রেজিস্টার্ড ফার্মাসিস্ট নিয়োগের যে বিধান রয়েছে, তা প্রশাসন থেকে নিশ্চিত করা একান্ত আবশ্যক। সময় এসেছে ভেজাল ও নকল ঔষধ বাণিজ্য বন্ধের। ভেজাল ও নকল ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধের দাবি সব জনমহলে। ভেজালবিরোধী গতানুগতিক অভিযান না চালিয়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন করা খুবই জরুরী। বর্তমানে ঔষধের হীন ও অসুস্থ ব্যবসা যদি সরকার কঠোর হাতে দমন করে তবে, দেশ আরো একধাপ এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আরো প্রশংসিত হবে। মানুষও রেহাই পাবে সিন্ডিকেটের গলাকাটা মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও মরমী গবেষক