সিনহা হত্যার বিচার ভুক্তভোগি মানুষকে সাহস জুগিয়েছে

33

কাজি রশিদ উদ্দিন

সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার পর ফের বিচার বহির্ভুত হত্যা ও গুমের আলোচনা সামনে এসেছে। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনা হচ্ছে। বিগত দিনগুলোতে প্রায় দুই হাজার ৮৮ জন মানুষ বিচারবহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশে। জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটিতে পরিসংখ্যাটি উত্থাপিত হয়েছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ট্রিগার হ্যাপি বুলেটে’ এ ভাবে নিয়মিত মানুষজন প্রাণ হারাচ্ছেন। বিচারবহির্ভুত হত্যার শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা বিচার চেয়ে কোনো প্রতিকার পান না বরং যারা এমন অন্যায় কর্মকান্ডে সিদ্ধহস্ত তারা নাকি চাকরিতে পুরস্কৃত হচ্ছেন বলে পত্র-পত্রিকায় খবর বেরুচ্ছে। সিনহাকে হত্যার নির্দেশদাতা ওসি প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে অসংখ্য মানুষকে হত্যার অভিযোগের বিষয়টি দেশে তোলপার সৃষ্টি করেছে। সিনহাকে রাস্তায় হত্যার পর একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি মন্তব্য করেছেন, আদালত এখন রাস্তায় নেমে এসেছে। আইন, বিচার ও আদালতেও আর প্রয়োজন নেই। পরিস্থিতির এমন অবনতি হঠাৎ করে হয়েছে এমন নয়। বরং বলতে হবে একজন উর্ধ্বতন সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিচারবহির্ভুত হত্যার কারণে বিষয়টা এভাবে সামনে আসতে বাধ্য হলো।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন রাওয়ার পক্ষ থেকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিচারবহির্ভুত হত্যা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে ক্লাবের চেয়ারম্যান সাবেক মেজর খন্দকার নুরুল আফসার বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা ক্রসফায়ার ও হারিয়ে যাওয়ার নেতিবাচক দিক প্রকাশ পাচ্ছে। তবে বিচারবহির্ভুত হত্যা ও গুম নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিপজ্জনক অবস্থা। কারণ সত্য কথা বলতে গেলে হত্যা গুম ও হয়রানির আশঙ্কা এখনো বিদ্যমান।
ওসি প্রদীপ কুমারের ব্যাপারে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, তিনি টেকনাফ থানার দায়িত্বে থাকা ২২ মাস সময়ে ওই থানায় পুলিশের সাথে ‘বন্দুক যুদ্ধে’ প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৪ জন। মাদক চোরাচালান রোধে অবাধে মানুষ হত্যার লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। একই সময় যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে মাদকের ব্যবহার ও চোরাচালান বন্ধ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে। এত মানুষের প্রাণহানি কী কারণে? আরো জানা যাচ্ছে প্রদীপ ছিলেন এলাকার মূর্তিমান। তিনি নাকি মূলত ক্রসফায়ারকে ব্যবহার করেছেন অর্থ কামানোর ধান্দায়। তার ওই সব অপকর্মের ফিরিস্থি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে। ক্রসফায়ারের বেশির ভাগ ঘটেছে মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। স্থানীয়দের কাছে এলাকাটি ‘ড্রেথ জোন’ হিসেবে পরিচিত। পুলিশের পোশাকে তিনি পৈশাচিক কর্মকাÐ চালালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। উল্টো পুরস্কৃত হয়েছেন। সিনহা হত্যার পর পুলিশের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে তাতেও প্রদীপের দাপটের বিষয়টিও প্রকাশিত হয়। জেলার পুলিশ সুপার এখানে কি ভ‚মিকা পালন করেছিলেন তাও ভাববার বিষয়। এভাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে অপরাধের প্রতি ঝুঁকেছেন অনেকে। অপরাধ করে পুরস্কার মিললে তাদের দাপটে বাড়ে বৈ কমে না।
মেজর সিনহা হত্যার ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন বলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি কে বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিবেচনা করে অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হলে বিচারবহির্ভুত হত্যার যে সংস্কৃতি সেটি বন্ধ হবে না। এই বিচার নিয়েও মানুষের মনে সংশয় রয়েছে। দেশের সাধারণ নাগরিকদের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। অন্য দিকে অপরাধীদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে সেটি সম্পূর্ণ উল্টো। এরপরও মানুষ প্রত্যাশা করে, একদিন হয়তো বিচারবহির্ভুত হত্যার অবসান হবে। সে জন্য প্রয়োজন বর্তমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। যারা এ ধরনের ঘৃন্য কাজে জড়িত, তাদের সবাইকে শনাক্ত করা। পুরস্কার কিংবা অন্য জায়গায় পদায়নের বদলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা হলে পুলিশসহ দেশের অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলার মধ্যে প্রকৃত শৃঙ্খলা ফিরে আসতে পারে। সিনহার হত্যাকারী, নির্দেশদাতা ও অন্তরালের আরো কোনো পৃষ্ঠপোষক থেকে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে।
আমাদের দেশের শিক্ষিত ও সচেতন লোকেরা মনে করেন সব কিছুই রাজনীতির ব্যাপার। তারাই সব সঠিক কাজটি করবেন। এ রূপ ধারনা দেশে বিরোধী ও অনেক রাজনৈতিক দল থাকার তো প্রশ্ন ছিল না। তাই মুক্তি চিন্তার সচেতন বুদ্ধিজীবীর অভাব অনুভ‚ত হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভ‚মিকা ছিল দেশের জনগণের মুক্তি বা অধিকার নিশ্চিত করা এবং জনগণের অধিকার বা ফ্রিডম রক্ষায় দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকতে হবে বিশেষ ভ‚মিকা। এমনটিই আশা করা স্বাভাবিক ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ছিল আমাদের নিজস্ব যুদ্ধ। মূল দায়িত্ব ছিল আমাদের মুক্তি বা স্বাধীনতা অর্থবহ করার সাহসী ভ‚মিকা পালনের। আমরা তো তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসাবে নানাভাবে ভ‚ষিত করেছি। অনেক পদক দিয়েছি, এখনো অনেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। ভালো কথা।
একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে পুলিশ নৃশংসভাবে হত্যা করায় মুক্তিযোদ্ধা ও সামরিক বাহিনীর লোকেরা বিক্ষুব্ধচিত্তে সুবিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। অবশ্যই এটা তারা ঠিক কাজ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই যে ক্রসফায়ার হত্যা, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক অপহরণের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে তাও তাদের অজানা থাকার কথা নয়। তার পরও আমরা প্রত্যাশা করব হত্যাকারীরা সাজা পাবে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা আর তার জীবন ফিরে পাবেন না। কিংবা লুটপাটের জন্য মানুষ হত্যা করার মত সহজ ব্যবস্থাও আর হবে না। তা আমরা বলতে পারি না। তবে এটুকু মানি, সিনহার হত্যা নিয়ে যেভাবে ক্ষোভের প্রকাশ পেরেছে এবং অপরাধীদের বিচারের তোড়জোড় চলছে তাতে সংক্ষুব্ধ জনমনে কিছুটা সাহস এনেছে এবং এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে পূর্বের ঘটনায় অনেক হত্যা মামলা দিয়েছে।
তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। মেজর সিনহার খুনিদের বিচার হলেও খুন-গুমের এই সংস্কৃতি থেকে জনগণ কতটা মুক্তি পাবে। বিষয়টির তদন্তে গভীরে গেলে দেখা যাবে কত ব্যাপক। একজন ওসির নির্দেশে পুলিশ মেজর সিনহার ওপর একের পর এক গুলি ছুড়েছে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ অফিসারকে কোনো কিছু ভাবতে হয় নি। মনে হয় যে জনগণকে বলা হয় দেশের মালিক তাদেরকে অধিকারহীন অসহায় মনে করেই সেই জনকে সে যেভাবে পারছে তাদেরও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ধন সম্পত্তি নিয়ে নিচ্ছে। টেকনাফ থানার ওসির নির্দেশে পুলিশের লোকজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে প্রকাশ্যে গুলি করে মেরে ফেলল। জানাযায়, অন্য ওসিরাও বহু লোক হত্যা করে প্রচুর অর্থ কামিয়েছে। তারা অনেকেই সাধারণ জনগণের জমিজমা অন্যায়ভাবে হাতিয়ে নিয়েছে। ক্রসফায়ারে মানুষ মারা পুলিশের জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে। পুলিশকে সঠিক পথে রাখা যে কত কঠিন হয়ে গেছে, তা একটু নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলেই বোঝা যাবে। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবেই আছে। বিনাবিচারে হত্যা করার মতো শত্রæ কি এদেশে আছে ? ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রত্যেকের মৌলিক ও মর্যাদার বিষয়। তাই অধিকার সচেতন শিক্ষিত লোকেরা সুবিধাবাদী ভ‚মিকায় থাকলে দেশ জমিদারি স্টাইলে চলবে। জনগণ রক্ত দেবে কিন্তু অধিকার থেকে বাইরে থাকবে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন কিছু মারাত্মক ত্রæটি রয়েছে, যা শিক্ষিতদের চাকরিপ্রার্থী ও নতজানু হতে শেখাচ্ছে। স্বাধীন দেশে শিক্ষিত লোকদের জ্ঞান এবং দূরদৃষ্টিকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষায় অপরিহার্য মনে করা হয়। শিক্ষিত সচেতন লোকেরাও সেভাবে তাদের দাঁয়িত্ব পালন করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেন। কিন্তু কেন জানি মনে হয় আমাদের শিক্ষিতজনেরা এ সত্য উপলব্ধি করতে পারছেন না। নিজেদের সুবিধার জন্য তারা মনে করেন। নিজেদের সুযোগ সুবিধা ঠিক থাকলেই হলো বিষয়টি তাদের নিজেদের জন্যও লজ্জা কর।
আমরা কথায় এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলে থাকি, কাদের রক্তে ? জনসাধারণের রক্তে। জনগণের রক্তেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জন করার অর্থ হচ্ছে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার ব্যবস্থা, যার দায়িত্ব জনস্বার্থ ও জনগণের অধিকার এবং জনগণ প্রদত্ত শাসন মেনে চলা। সব আমলের ক্ষমতাসীনরা সেই শপথ নিয়ে মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী হন। রাজনীতিতে তর্ক-বিতর্ক সমালোচনা থাকবে। বাদ প্রতিবাদও থাকবে। কিন্তু জনগণের সরকার হবে আমাদের সকলের সরকার। অবশ্য কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট