সিজেকেএস নির্বাচনে আবারো সমঝোতার কমিটি! পাতানো খেলা নয় কাউন্সিলররা চান নির্বাচন

119

১৯৯২ সালে বন্যার্তদের সাহায্যার্থে আয়োজিত চট্টলা কাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেছিল চট্টগ্রামের দুই জনপ্রিয়তম দল আবাহনী ও মোহামেডান। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের ২৫ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যালারি-প্যাভিলিয়নে। নির্ধারিত সময়ে ড্র ম্যাচটি বাকী প্রসিডিংসে না গিয়ে দু’দলের অধিনায়ক যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করলে তুলকালাম কান্ড বেধে যায়। ভাই (পাতানো) খেলা চাই না ¯স্লোগানে স্টেডিয়াম এলাকার আকাশ প্রকম্পিত হয়। মাঠে শুরু হয় ইস্টক বৃষ্ঠি। কিছু সংখ্যক দর্শক কাঁটা তারের দেয়াল টপকে মাঠে প্রবেশ করে পাতানো খেলার দায়ে অভিযুক্ত করে খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের উপর হামলা চালায়। তাদের রক্ষায় পুলিশ লাঠি চার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে। পুরো স্টেডিয়াম ও তৎসংলগ্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটায় মারাত্মক আহত হন ফটো সাংবাদিক মশিউর রেহমান বাদল. সুভাষ কারণসহ ডজনাধিক সাংবাদিক ও অগণিত ক্রীড়ামোদী। প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ ও উপভোগ্য ফুটবল ম্যাচের ভাগ্য মাঠের পরিবর্তে সমঝোতায় বা টেবিলে হওয়ার বিষয়টা মানতে না পেরে সেই যে দর্শকরা স্টেডিয়াম ছাড়ল তাদেরকে আর মাঠমুখি করা যায় নি দীর্ঘ ২৮ বছরেও।
একই জিনিস আমরা দেখেছি চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচনেও। ১৯৯৯, ২০০৩, ২০০৭ ও ২০১১ সালে প্রাণবন্ত নির্বাচনের মাধ্যমে সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হলেও ২০১৫ সালে সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি করা হয়। এর ফলে যারা বাদ পড়েছেন তারা প্রায় স্টেডিয়ামে আসাই ছেড়ে দেন। সাব কমিটিগুলো গঠনের পর দেখা যায় বিনাভোটে নির্বাচিত এসব কর্মকর্তারা একেকজন ৩/৪টি পর্যন্ত কমিটির চেয়ারম্যান বা সেক্রেটারি হয়ে যান। স্টেডিয়ামে আনা-গোনা কমে গেল আরো অনেক সংগঠকের। পরে অবশ্য দু’একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বিষয়টি সাধারণ সম্পাদকের নজরে আনলে তিনি কমিটিগুলো রিশাফলের নির্দেশ দেন এবং তা বাস্তবায়িত হয়। তারপরও সুষ্ঠুভাবে সিজেকেএস পরিচালিত হয়েছে বলা যাবে না। কারণ মেয়র সাহেব যতই আন্তরিকতা দেখান না কেন কাউন্সিলরদের ম্যান্ডেটবিহীন চেয়ার পাওয়া কর্মকর্তারা গণতন্ত্রের চর্চা না করে অধিকাংশই স্বেচ্চাচারিতা আর স্বৈরাচারি মনোভাব দেখানোয় অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্চল করে তুলতে যেমন সফল হয়েছেন তিনি তুলনামূলকভাবে তেমন সাফল্য পান নি ক্রীড়া ক্ষেত্রে কোয়ালিটি উন্নয়নে। বৈশাখী উৎসব, ইফতার পার্টিসহ সিজেকেএস’র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কর্মকর্তা-কাউন্সিলরদের ব্যাপক হারে অনুপস্থিতি দেখে হতাশা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে বহুবার।
আগামীতে আর সিজেকেএস ইলেকশন করার অভিপ্রায় না থাকলেও অসমাপ্ত কাজ শেষ করার লক্ষ্যে আলহাজ আলী আব্বাসসহ কাউন্সিলরদের অনুরোধে ৩য় বারের মত সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য সম্মত হন আ জ ম নাছির উদ্দীন।
এবার তিনি ঘোষণা দেন, ওপেন করে দিলাম- সরাসরি নির্বাচন করে জিতে ইসিতে আসতে হবে।
দীর্ঘ ৮ বছর পর বহূল প্রত্যাশিত সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচনের ঘোষণায় সরগরম হয়ে উঠে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম চত্বর। তাদের অতীত কর্মকান্ডের ফলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন হবে ভেবে একটি পক্ষ অবশ্য আবারও সিলেকশনের অপতৎপরতা শুরু করে প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু মুখফুটে বলতে না পারলেও কাউন্সিলরদের টিউন রিড করে মেয়র ঠিকই বুঝেছেন, কমপক্ষে বেশির ভাগ কাউন্সিলর চান নির্বাচন হউক। আর যারা গতবার এবং এবার কাউন্সিলর হয়েছেন তাদের ভোটাধিকার হরণ করার অধিকার কি কারো আছে? হাতে গোণা কয়েকজন জনবিচ্ছিন্ন, সুবিধাভোগী, নামধারী সংগঠকের পাল্লায় পড়ে মেয়র কি বিতর্কিত হতে চাইবেন? নিজের জয় তো নিশ্চিত, সেক্ষেত্রে নির্বাচন করতে সাহস পায় না এমন ভীরু, অকর্মণ্যদের তিনি কেন সিজেকেএস’র প্রাণ কাউন্সিলরদের উপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ করে দিয়ে সমালোচনার পাত্র হবেন? বরং নিজের ইচ্ছামত পদে ভোট করে কাউন্সিলরদের সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটিতে আসার সুযোগ দিলে অভিভাবককে নিয়ে কেউ কিছু বলার সুযোগ থাকবে না। ‘একমাত্র পাগল ছাড়া সবাই নিজের ভাল-মন্দ বিচার করতে পারে। এক্ষেত্রে মেয়র মহোদয়ও নিজের এবং ক্রীড়াঙ্গনের ভালটা দেখবেন’ বলেই মনে করেন একজন বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক।
এদিকে গুটি কয়েক মতলববাজ কর্মকর্তা ফন্দি-ফিকির আর অন্ধকার পথে চেয়ারে বসার অপতৎপরতা চালালেও সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটির আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে চট্টল ক্রীড়াঙ্গনে। মোট ৯০টি মনোনয়ন পত্র বিক্রী হয়েছে যা সিজেকেএস নির্বাচনের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। তবে তাঁর অজান্তে বিভিন্ন পদে ফরম কেনায় একজন কাউন্সিলরের তীব্র সমালোচনা করেছেন সিজেকেএস নির্বাহী সদস্য ও তায়কোয়ান্দো কমিটির চেয়ারম্যান মশিউর রহমান চৌধুরী, তাহেরুল আলম চৌধুরী স্বপনসহ বেশ ক’জন নির্বাচন প্রত্যাশী কাউন্সিলর। তাঁদের মতে, আমরা কোন্ পদে নির্বাচন করব সেটা আমাদের ব্যাপার। আমাদের ফরম আমরা কিনব। নির্বাচন গড়াপেটার কারবারিদের মেকানিজম অপতৎপরতা কিসের ইংগিত?
উল্লেখ্য, গতবার ছাড়া আগে অনেকবার সিজেকেএস নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু এত ব্যাপক সংখ্যায় মনোনয়ন পত্র কেনার হিড়িক আগে কখনো দেখা যায় নি। একজন একাধিক পদে ফরম কিনেছেন। আজ ফরম জমা দেয়ার পরই বোঝা যাবে কারা কারা নির্বাচন করছেন। স্টেডিয়াম পাড়ায় জোর গুঞ্জন চলছে-মেয়র মহোদয় অর্থাৎ সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এর গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কেউ প্রার্থী নাও হতে পারেন। তবে একমাত্র প্রার্থী হিসেবে গতকাল সদস্য পদে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়েছেন উল্লাস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, সিজেকেএস রাগবি সম্পাদক প্রবীন কুমার ঘোষ।
সিজেকেএস নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও বিতর্কহীন করার লক্ষ্যে আ জ ম নাছির উদ্দীন গতকাল সন্ধ্যায় নির্বাচনে আগ্রহী সবাইকে নিয়ে বসেন এবং তাদের কথা শুনেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কন্ফারেন্স মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত রুদ্ধদ্বার মত বিনিময় সভায় জনা চল্লিশেক আগ্রহী প্রার্থী বক্তব্য রাখেন।
বক্তারা প্রায় সবাই সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের পক্ষে মত দেন। মেয়রও কাউন্সিলরদের সেন্টিমেন্টের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে সিজেকেএস’র কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্যে সবাইকে সুষ্ঠু নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের উদাত্ত আহবান জানান। সাধারণ সম্পাদক পদে আ জ ম নাছির উদ্দীনকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচনের ব্যাপারে সভায় প্রস্তাব উঠলে সবাই নির্দ্বিধায় তা সমর্থন করেন। অর্থাৎ সিজেকেএস সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ৩য় বারের মত দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। তবে দলাদলি-গ্রæপিং না হওয়ার জন্য অন্যান্য পদেও নির্বাচন না করে সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য প্যানেল তৈরি করে জমা দেওয়ার জন্য ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক হিসেবে আবারও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আগ্রহী প্রার্থীরা প্রায় সবাই মনোনয়ন পত্র তাঁর হাতে জমা দিয়েছেন।
জানা গেছে, আজ বেলা ৩টার মধ্যে তিনি একটি কমিটি দাড় করাবেন এবং মনোনীতদের যথাসময়ে ডেকে পে অর্ডার নিয়ে ফরম জমা দিবেন। সে হিসেবে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে স্পষ্ট হয়ে গেল, চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থায় (সিজেকেএস) এবারও নির্বাচন হচ্ছে না, আবারও কমিটি গঠন হচ্ছে সমঝোতার মাধ্যমে। আর আজ বিকেল ৫টার মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে যাবে কারা এবারের সিজেকেএস কার্যনির্বাহী কমিটিতে স্থান পাচ্ছেন যার মধ্যে উপজেলা কোটায় প্রদীপ ভট্টাচার্য ও হারুর আল রশিদ এবং নারী কোটায় রেজিয়া বেগম ছবি ও রেখা আলম ইতোমধ্যেই তাদের আসন নিশ্চিত করেছেন।