সিএসআর কার্যক্রমে কর্পোরেটদের এগিয়ে আসা উচিৎ

33

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিক দায়িত্ব (সিএসআর) নিয়ে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। তবে সিএসআর-এর ধারণা কিন্তু বেশ পুরোনো এবং ব্যক্তিগত উদ্যোক্তাদের মাঝ থেকে এসেছে। ফোর্ড মোটর গাড়ির মূল মালিক হেনরি ফোর্ড তার শ্রমিকদের তখনকার অন্যান্য শিল্পপতির থেকে বেশি বেতন দিতেন যাতে শ্রমিকরা সচ্ছলতার সঙ্গে জীবন-যাপন করতে পারেন। ভারতের শিল্পপতি টাটা যেখানে শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলেছেন সেখানে একটি উপশহরও গড়ে তুলেছেন। সেখানে হাসপাতাল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সিএসআর আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। দেশের বাণিজ্যিক আর্থিক আইনেও এটি সংযোজন করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সিএসআর কার্যক্রমের তৎপরতা বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান সিএসআরে বেশ আগ্রহী ছিলেন এবং তৎপরতার সঙ্গে একে জোরদার করার জন্য কাজ করে গিয়েছিলেন। তবে সেই সঙ্গে একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
আমাদের প্রত্যাশা যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, জলবায়ু , স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, পুষ্টি, রোড এক্সিডেন্ট, এইচআইভি এইডসসহ নানারকম জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন। বাংলাদেশে কিডনি, হৃদরোগ ও ক্যান্সারসহ কিছু রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। মাঝে মাঝেই হতাশাগ্রস্ত ও অসহায় মা-বাবাকে পত্রিকার মাধ্যমে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে দেখা যায়। আরো একটি কাজ করা যেতে পারে, বেশকিছু লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিগত মালিকানায় হাসপাতাল রয়েছে। সেখানেও কিছুসংখ্যক হতদরিদ্র রোগীর চিকিৎসার সুযোগ দেয়া যেতে পারে। দেশের মানুষের সেবা করার মানসিকতা বড়। আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ পেশায় থেকে সমাজের কল্যাণ করতে পারি। ড. ইব্রাহিম তো আমাদের জন্য অনেক বড় প্রেরণা হওয়ার কথা। কিভাবে বারডেমের মতো এতো বড় একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দিয়ে গেলেন।
জনকল্যাণে মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের অবদান অনুকরণীয়। সে শুধু নিজেই ফাউন্ডেশন করে থেমে থাকেনি অন্যান্যদেরও সে পথে আসার আহবান জানিয়েছে। অনুমান করা হয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে টাকার অঙ্কে ৫ লাখ বিলিয়নিয়ার রয়েছেন। তাদের অনেকে ফাউন্ডেশন গঠন করে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত হতে পারেন। পাশ্চাত্যের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তা হলো তাদের উপার্জিত অর্থের একাংশ দিয়ে কোনো ফাউন্ডেশন বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তৃতীয় বিশ্বের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর কল্যাণ করা। তাদের দেশের অভ্যন্তরে তেমন একটা প্রয়োজন হয় না বলে আন্তর্জাতিকভাবে কর্মসূচি গ্রহণ করেন।
তবে আমাদের দেশেও বড় বড় কোম্পানিগুলো সিএসআর কার্যক্রমে এগিয়ে আসছে। এটা আশা জাগানীয়া খবর। বিশেষ করে ব্যাংকগুলো এ খাতে বেশ সুনাম অর্জন করছে। তারা বেশকিছু এনজিওকে ফান্ড দিয়ে যাচ্ছে। ওই এনজিওগুলো তাদের ফান্ড দিয়ে জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে, যার দরুণ সমাজ উপকৃত হচ্ছে। এভাবে অন্যান্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি এগিয়ে আসে দেশের অনেক পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন ধনী দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা অনেক আগে থেকে জনকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে তারা ফান্ড করে যাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলাদশ অন্যতম। এ ফান্ড দিয়ে দেশে অনেক কাজ করা হচ্ছে। যেমন: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, সুপেয় পানি , আইনি খাতে ও অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমে কাজ করা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার এগিয়ে আসলে বিশ্ব থেকে আরো ফান্ড জোগার করা সহজ হত। এনজিও ব্যুরো যদি বিদেশ থেকে যে ফান্ডগুলো আসে তা যদি তাড়াতাড়ি ছাড় দেয় তাহলে বেসরকারি সমাজ উন্নয়ন সংস্থাগুলো আরো সহজভাবে কার্যক্রম চালাতে পারবে।
তবে এখন বিদেশী দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ফান্ড দেয়া কমিয়ে দিচ্ছে তা আমাদের মত দেশের জন্য অশনি সংকেত। বর্তমানে বিদেশি ফান্ডের অভাবে অনেক এনজিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার যদি একটু ভূমিকা রাখে তাহলে আরো ফান্ড পাওয়া সম্ভব। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেও অনেক বড় বড় ফান্ড অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো এখন বলছে তোমাদের দেশে এখন কোটিপতি আছে। তাদের থেকেও তোমরা ফান্ড সংগ্রহ করতে পার। আমরা আর ক’দিন তোমাদের ফান্ড দিয়ে যাব। তাই দেশীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সিএসআর কার্যক্রমে দ্রুত এগিয়ে আসা উচিৎ।
মৃত্যুর আগে স্টিভ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জীবন সম্পর্কে যা বললেন। স্টিভ জবস যখন মারা যান তখন এ্যাপল ব্যাংক একাউন্টে জমা ছিল তার ৫০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। টেকনোলজির এই রাজপুত্র মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অন্তিম জীবন সম্পর্কে যা বলেছিলেন- কথাগুলো নিম্নরূপ :
বাণিজ্যিক দুনিয়ায় আমি সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করেছি যা আপনাদের কাছে সাফল্যের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। কিন্তু, এ কথা ধ্রুব সত্য কাজের বাইরে আমার সামান্যই আনন্দ ছিলো। সম্পদের প্রলোভনে বিভোর ছিলাম সারা জীবন। আজ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে যখন জীবনটাকে দেখি-তখন আমার মনে হয় আমার সব মান-সম্মান, খ্যাতি আর অর্জিত সম্পদ আসন্ন মৃত্যুর সামনে একেবারেই ম্লান, তুচ্ছ আর অর্থহীন। মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তাহলো মানুষের সাথে সু-সম্পর্ক তৈরি করা। শুধু সম্পদের পিছরে ছুটলে মানুষ আমার মত এক ভ্রান্ত মানুষে পরিণত হতে পারে।
তিনি আরো বলেন-সম্পদ আহরণ সবকিছুই নয়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবার হৃদয়ে ভালোবাসা অনুভব করার জ্ঞান দিয়েছেন। কেবলমাত্র সম্পদের মোহে জড়িয়ে পড়ার জন্য নয়। এই যে মৃত্যু শয্যায় শুয়ে আছি। কই, সব সম্পদতো এই বিছানায় নিয়ে আসতে পারিনি। জীবনের যে পর্যায়ে আপনি আজ থাকুন না কেন মৃত্যু পর্দা আপনার জীবনের সামনে হাজির হবেই। সাঙ্গ হবে জীবন। তাই এই নশ্বর জীবনের পরিসমাপ্তির আগে পরিবারের জন্য, আপনজনের জন্য বন্ধুদের জন্য হৃদয়ে ভালোবাসা রাখুন। নিজের জীবনটাকে ভালোবাসুন। গরিব মানুষকে সাহায্য করার কথাও তিনি বলেছিলেন।
স্টিভ জবসের মৃত্যুর আগের কথাগুলো খুবই অনুকরণীয়। তাই তাঁর কথা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিলিয়ন-মিলিয়নদের সামাজিক কার্যক্রমে এগিয়ে আসা উচিৎ। সেবাতে শান্তি, সুখ এবং মনখোলা হাসি।

লেখক : প্রাবন্ধিক