সাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ

54

১৩ নভেম্বর বাংলা সাহিত্যের নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন। তার কাজ, তার সৃষ্টি বিশাল। তা বিশ্লেষণ করার জ্ঞান বা দক্ষতা কোনটাই আমার নেই। আমি তা করবোও না। হুমায়ূন আহমেদকে স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে গণ্য করা হয়। বহুমুখী প্রতিভাসম্পুন্ন বলতে যাকে বোঝায় তিনি ছিলেন ঠিক তেমন একজন প্রতিভাধর মানুষ। দুই বংলায়তেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয় একজন লেখক। তার সৃষ্ট চরিত্র বইয়ের উপন্যাসের পাতা থেকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন। শরৎচন্দ্রের দেবদাস, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন যতটা জীবন্ত ততটাই জীবন্ত তার মিসির আলি, হিমু চরিত্রগুলো। প্রেক্ষাপট ভিন্ন তবে জীবন্ত বটে। তিনি সমান দক্ষতায় ছোলগল্প লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন, চলচিত্র নির্মাণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে তার নাটক ও সিনেমায় প্রচারিত গানগুলো তো মানুষের মুখে মুখে। তিনিই হাসন রাজার গান সারা দেশে জনপ্রিয় করেছেন। তার হাত ধরে কত গুণী অভিনেতা নাট্য জগতে এসেছে। তিনি দেখিয়েছেন বাংলা সাহিত্যে কিভাবে পাঠক টানতে হয় এবং ধরে রাখতে হয়, কিভাবে নাটকে গুণগত পরিবর্তন এনে মানুষকে টিভি সেটের সামনে বসিয়ে রাখা যায়। তিনি আমাদের দেশের প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ। একটা সময় একেকজন লেখকের বা সম্মিলিত কয়েকজন লেখক কবির লেখায় প্রভাবিত হয়ে লেখালেখি চলে। এখন বেশিরভাগ লেখাতেই হুমায়ুন আহমেদের লেখার ছায়া, নাটকগুলোতেও হুমায়ুন আহমেদ। মোট কথা হুমায়ুন আহমেদ বাঙালি জাতির প্রাণের মাঝে বসে আছেন।
পৃথিবী জুড়েই তার বহু ভক্ত পাঠক রয়েছে। তার অসংখ্য পাঠকের মধ্যে একজন আমি। অবশ্য আমি তার কতটা সিরিয়াস পাঠক সে বিচার করতে পারবো না। কোনদিন তার কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমার অনেক ইচ্ছার মধ্যে যদিও এটাও একটা ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তার সৃষ্টির কাছাকাছি থাকাও তো তার কাছাকাছি থাকারই সমান। ছোটবেলায় যখন কোথাও কেউ নেই নাটক মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখতাম সত্যি কথা বলতে তখনো কিন্তু হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে জানতাম না। বয়সটাও অনেক কম ছিল। তখন শুধু বাকের ভাই, বদি এসব চরিত্র নিয়ে এক ধরনের ইমোশন ছিল। বহুব্রীহী দেখেছি কিন্তু তখনো হূমায়ুন আহমেদকে জানতাম না। পরে বহুব্রীহি উপন্যাস পড়ে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল। মাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়ে কলেজে পড়ার সময় বই পড়ার সুযোগ এলো। কলেজ লাইব্রেরিতে প্রচুর বই ছিল। প্রথম বছরে একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি কার্ড বরাদ্দ ছিল। প্রতি কার্ডে আঠারোটি বই পড়া যেত। আমি আমার কার্ড দিয়ে প্রথম তুললাম হুমায়ুন আহমেদের ১৯৭১ উপন্যাসটি। শেষ করলাম এক নি:শ্বাসে। আমার প্রাণ তখন আরো বই চায়। প্রথম বছর নিজের আঠারোটি বই পড়া শেষে বন্ধুর কার্ড দিয়ে আরো আঠারোটি পড়েছিলাম। তবে এ সময়টাতে হুমায়ুন আহমেদেও কোন বই পড়া হয়নি। তখন মফস্বল বা গ্রামে বই পড়ার রীতি এতটা ছিল না। বিশেষ করে তা যদি আমার মত নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবার হয়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার পর আমার হাতে এলো মিসির আলীর অমনিবাশ বই। বলা বাহুল্য ধার করা। যে বইটির গল্প নিয়ে পরে কয়েকটি আলাদা আলাদা বই প্রকাশিত হয়েছে। এর প্রথম লেখা ছিল খুব সম্ভবত দেবী। মিসির আলীর নামের শক্ত লজিকের মানুষের সাথে সেই পরিচয়। ভাল লাগাও তখন থেকেই। এত স্পষ্ট বর্ণনা বলে আমার মনে হয়েছে যে চোখ বন্ধ করলেই আমার মন মিসির আলীকে তৈরি করে নিতে পারে। হিমুর সাথে পরিচয় হয় আরো পরে। তবে রূপা এবং শুভ্রর সাথে ততদিনে পরিচয় হয়েছে। আমার বই পড়ার শখের পূর্ণতা পায় অনার্স পড়াকালীন। যে মেসে উঠেছিলাম সেখানে এক বড় ভাইয়ের বই পড়ার নেশা ছিল। তার রুমে প্রচুর বই ছিল। বাংলাদেশ, ভারতসহ পাশ্চাত্য দেশের বইগুলোও ছিল প্রচুর। যদিও কাউকে বই দিত না কিন্তু আমার আগ্রহ দেখে শুধু আমাকে বই ধার দিত। কিন্তু আমার মন খুঁজতো যে লেখকের বই তার বই বড় ভাইয়ের কাছে ছিল না। ফলে সেই অতৃপ্তি থেকেই যাচ্ছিল। যাওয়া শুরু করলাম পাবলিক লাইব্রেরীতে। সেখানে খুঁজে পেলাম আমার মনের চাওয়া বইগুলো।
আমি প্রথমেই বলেছি হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে আমার খুব বেশী কিছু জানা নেই। আমি শুধু একজন পাঠকের অন্তরের উপলদ্ধিই লিখতে চেয়েছি। যদিও অনেক পাঠক সমালোচকের মুখে আমি তার লেখার গভীরতার সমালোচনা শুনেছি। তবে সমালোচনা থাকবেই। তবে তার সৃষ্টি সব কিছু ছাপিয়ে গেছে। যে লেখা পাঠকের অন্তরের গভীরে দাগ কাটতে জানে তার থেকে গভীর লেখা আর কি হতে পারে? তিনি চেয়েছিলেন তার বই পাঠক পড়ুক। তাই হয়েছে। আর তাই তিনি পাঠকের হৃদয়ে। তার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়েও কম সমালোচনা হয়নি। তবে সে তো সমালোচকরা রবীন্দ্রনাথের ব্যাক্তিগত জীবনেও আতশ কাঁচ লাগিয়ে সমালোচনার বস্তু খোঁজে। তার সমসাময়িক এতটা জনপ্রিয় আর কেউ ছিল বলে আমার জানা নেই। হুমায়ুন আহমেদের স্পর্শ যেন সফলতার অন্য নাম। সহজ, সরল সাবলীল ভাষায় পাঠককে গল্পের ভেতর টেনে নেওয়ার যে ক্ষমতা তা তার ছিল। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সফল হয়েছেন। নাটকের দর্শকদের এক নির্মল বিনোদন দেয় তার নাটকগুলো। চলচিত্রের কথা যদি বলি তাহলে সেই আগুনের পরশমনি থেকে শুরু করে সবগুলোই দেখেছি। বাদশা নামদার পরে মনে হয়েছে ইতিহাসের এমন চমৎকার একটি বিষয় গল্পের মাধ্যমে জানা যায় না পরলে বিশ্বাস করাই কষ্ট। আবার দেয়াল পরে নিজ দেশের ইতিহাসের অনেকখানি জানতে পেরেছি। রাবণের দেশে আমি এবং আমরা বইটি পড়ে সেদেশের বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য জেনেছি। অনিল বাগচীর একদিন আমি কমপক্ষে পাঁচবার পড়েছি। প্রতিবারই পড়া শেষে অনিল ছেলেটার জন্য আমার মন এক ধরনের বিষন্নতায় ডুবে গেছে। এরকম অনেক অনেক স্মৃতি রয়েছে হুমায়ুন আহমেদের সৃষ্টিকর্মের সাথে।
আমার মনে আছে হুমায়ুন আহেমেদের মৃত্যুর খবর যখন শুনি তখন একেবারেই বিশ্বাস হয়নি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল চিকিৎসা শেষে তিনি আবার ফিরে আসবেন। আমাদের জন্য আবারো লিখবেন। প্রতি বইমেলায় খোঁজ নেব হুমায়ুন আহমেদের কি বই এসেছে। আগ্রহ নিয়ে সেই বই কিনবো। তারপর রাত জেগে একটানে পড়ে শেষ করবো। আমরা মিসির আলীর নতুন যুক্তি নিয়ে উপন্যাস পাবো। হিমুরা হলুদ পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে রাতে রাতে রাজপথে হেঁটে বেড়াবে। সেই পাঞ্জাবীর কোন পকেট নেই। পায়ে কোন জুতা নেই। কিন্তু তা হয়নি। যে মানুষটা জোৎস্না ভালবাসতো, বৃষ্টির জল ভালবাসতো, বৃষ্টি এলেই ভিজতে নেমে যেত বলে তার অনেক লেখায় পড়েছি তিনি চলে গেলেন। চলে গিয়েও এই আমাদের ভেতর বেঁচে রইলেন।