সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ এবং অস্ত্র বাজার

69

সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে সারা বিশ্বে অস্ত্র বেচা-কেনার যেন হিড়িক পড়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই সৌদি-আরব সফরে গিয়ে সাউদী বাদশার সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর বিরাট অংকের অস্ত্র বিক্রয়ের জন্যে সৌদি আরবের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। আবার কিছুদিনের মধ্যে সাউদী বাদশা রাশিয়ায় গিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে আলোচনার পর রাশিয়া থেকে বিশাল অংকের অস্ত্র কিনেছেন। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও রাশিয়া থেকে বিশাল অংকের অস্ত্র কিনেছেন। আগে বিশ্বে অস্ত্র ক্রয় বিক্রয়ের ব্যাপারটা অন্যরকম, এটি ছিল কূটনৈতিক সম্পর্কনির্ভর। এখন কিন্তু সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে আমূলভাবে। এখন অবস্থা হয়েছে ডাল-চাউলের মত যেখান থেকে ইচ্ছা অস্ত্র কিনতে পারেন। যারা এই অস্ত্র কিনছেন তাদের মধ্যে এক গ্রæপ বলছে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দমন করতে তাদের অস্ত্রের প্রয়োজনে কিনতে হচ্ছে। আর এক দল বলছে প্রচলিত শান্তি বজায় রাখতে তাদের প্রয়োজনীয় অস্ত্র কিনতে হচ্ছে। এই ভাবে বিশ্বে অস্ত্র কেনাবেচার একটা হিড়িক পডেছে। বিশ্বে ঠাÐা যুদ্ধের যুগে যে পরিমাণ অস্ত্র কেনাবেচা হয়েছিল বর্তমানে সে সময়ের থেকেও অস্ত্রের বাজার আরও বেশি রমরমা ভাব ধারণ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশে বিরামহীন যুদ্ধ চলছে। সেন্ট্রাল এবং দক্ষিণ আমেরিকা এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে অস্ত্র বানিজ্য ৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে যে চলিত চুক্তি বিদ্যামান রয়েছে তা ইতিমধ্যে ১০৫ টি রাষ্ট্র অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু প্রচলিত (ঈড়হাবহঃরড়হধষ) অস্ত্রের ব্যপারে যে সব শর্ত চুক্তিতে রয়েছে, সেসব শর্ত অনেক রাষ্ট্রেই মানছে না। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনের সময় চুক্তির প্রায় শর্ত ভঙ্গ করেছে। জাতিসংঘের চলতি বৎসরে দেয়া এক রির্পোটে উল্লেখ করা হয়েছে যে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরাইল, ফিলিপাইন, রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে ১৪ টি অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানি যুদ্ধ জেট, যুদ্ধ জাহাজ, মিসাইল সহ অন্যান্য ভয়ংকর যুদ্ধ সরঞ্জাম মিয়ানমারে অহরহ পাঠিয়েছে।
এতে কোন সন্দেহ নেই যে রোহিঙ্গা গণহত্যায় উপরোল্লিখিত দেশসমূহের প্রেরিত অস্ত্র অনায়াসে ব্যবহার করা হয়েছে এবং জাতিসংঘের রিপোর্টেও সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে ১৪ টি অস্ত্র বিক্রেতা কোম্পানি কর্তৃক সরবরাহকৃত যুদ্ধ জেট, যুদ্ধ জাহাজ, মিসাইল এবং সরবরাহকৃত অন্যান্য ভয়ংকর যুদ্ধ সরঞ্জাম নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গাদের উপর ব্যবহার করেছে এবং তাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মানবাধিকার লংঘন করেছে এবং ভয়ংকর অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হিসাবে সাতটি দেশকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে সাতটি দেশের মধ্যে সবচাইতে ভয়ংকর অস্ত্রগুলি মিয়ানমারের সেনবাহিনীকে ইসরাইলই সরবরাহ করেছে। অথচ, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অস্ত্র-সরবরাহকারী যদি জানে যে সেই ভয়াবহ অস্ত্রগুলি ভয়ংকর অপরাধে ব্যবহার হবে তা সত্তে¡ও যদি সরবরাহ করা হয় তাহলে সরবরাহকারী দেশও অপরাধী বলে গণ্য হবে। এখন জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নিধনে (এবহড়পরফব) এই সব অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে সু-স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে। এই কারণে যদি ইসরাইলকে বিচারের আওতায় আনা না যায় তাহলে বুঝতে হবে জাতিসংঘ একটি দন্তহীন সংস্থা। এই সংস্থা দিয়ে বিশ্ব-শান্তি কায়েম করা অসম্ভব। মানবাধিকার সংস্থাগুলির রিপোর্টে বলা হয়েছে ইসরাইল মিয়ানমারকে সীমানা পাহারার জন্য ১০০ ট্যাঙ্ক, নৌযান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করেছে। মিয়ানমারকে ইসরাইলের যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ ২০১৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। পরে ইসরাইলের আদালত মিয়ানমারে ইসরাইল কর্তৃক অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আদেশ দেন। ইহা সত্তে¡ও মিয়ানমার এবং ইসরাইলের মধ্যে সম্পর্ক মধুর রয়েছে। কারণ রতনে রতন চেনার সত্যটা এখনও পৃথিবীতে অব্যাহত রয়েছে। এই বৎসরের জুন মাসেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একদল সিনিয়র কর্মকর্তা ইসরাইল সফর করেছেন এবং তাঁরা ইসরাইলের সর্বশেষ উৎপাদিত বিভিন্ন অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবর বের হয়েছে। উপরোক্ত উপায়ে মিয়ানমারের অস্ত্র সংগ্রহ ছাড়াও বিশ্বের আরও ৬০টির মত কোম্পানীর সাথে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত (ক) মিয়ানমার ইকোনমিক হোল্ডিং লিমিটেড এবং (খ) মিয়ানমার ইকোনমিক কর্পোরেশন-নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সাথে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি হয়েছে। এজন্যে জাতিসংঘের অনুসন্ধান মিশন উপরোল্লিখিত কোম্পানীগুলির উপর স্ব স্ব সরকারকে অর্থনৈতিক দন্ড আরোপ করার সুপারিশ করেছেন।
এম.এস.এফ. নামে সংস্থার অনুসন্ধানে জানা যায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ২৪ তারিখ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০০০ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে হত্যা করা হয়েছে। তন্মধ্যে ৩০ জন ছিল ৫ বৎসর বয়সের নিচে শিশু। যে অস্ত্র দিয়ে এই লোকগুলিকে মারা হয়েছিল তা ছিল চীন ও ভারতে তৈয়ারী। কাজেই নৈতিকতার দিক থেকে বিচার করলে চীন এবং ভারতকেই প্রথম মিয়ানমার সেনবাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। চীন এবং ভারতের মধ্যে যতই রাজনৈতিক মত-পার্থক্য থাকুক না কেন, উপরোল্লিখিত ব্যাপারে মত পার্থক্যের কোন কারণই থাকতে পারেনা। বিশ্বের পরাশক্তিগুলি বিশ্ব মানবতা রক্ষার প্রশ্নেরও যদি একমত হতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে বিশ্ব তার স্বাভাবিক ও সার্বিক ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে। কাজেই বিধাতার শেষ বিচারের জন্য অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আর অন্য কোন পথ থাকার কথা নয়।
অস্ত্র ব্যবসা যে ভীষণ লাভজনক ব্যবসা তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানে পরাশক্তির রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানেরাই সরাসরি নিজেরাই অস্ত্র বিক্রি শুরু করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই সাউদী আরবে তাঁর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম সফরেই সাউদী বাদশার সাথে সরাসরি আলোচনা করে একই বৈঠকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র বিক্রয়ের চুক্তি করেছিলেন। সোভিয়েট রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনও সাউদী বাদশা, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী-নরেন্দ্র মোদীর সাথে সরাসরি দর কষাকষি করে নিজেই অস্ত্র বিক্রয় করেছেন। অস্ত্র বিক্রয়ের জন্য বড় বড় দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টরা যেভাবে তৎপরতা দেখাচ্ছেন তাতে মনে হয় তাদের জন্য ইহা এত লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আপাত: বিশ্ব শান্তির কথা মনে থাকাটা স্বাভাবিক নয়। বিশ্ববরেণ্য নেতারাই যদি প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র বিক্রয়ের প্রতিযোগীতায় নেমে পড়েন তাহলে বিশ্ব শান্তির আর প্রশ্নই থাকেনা। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৮৯ সাল থেকে বিশ্বে অস্ত্র যুদ্ধে ২,৪৩৬,৩৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুধু ২০১৮ সালে মারা গেছে ৭৭,৩২০ জন। ২০১৭ সালে ৫৮৯০০০ জন। উল্লেখযোগ্য কোন যুদ্ধ ছাড়া যদি এত লোক মারা যায় তাহলে সত্যিই যদি যুদ্ধ সংঘটিত হয় তাহলে কি অবস্থা হবে?
বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিগুলিসহ সবগুলি দেশের কাছে যে পরিমাণ অস্ত্র আছে তা বর্তমান পৃথিবীর ন্যায় ডজনের মত পৃথিবী ধ্বংস করা যাবে। পৃথিবীর মানুষ সহ যে কোন প্রাণীর বাসের অযোগ্য হয়ে যাবে। তারপরও বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সারা বিশ্বে দৈনন্দিন তৈয়ার হচ্ছে। এর প্রতিকার কি? বিশ্বের কোন লোক এ প্রশ্নের উপযুক্ত উত্তর দিতে পারবে বলে আমার মনে হয়না। আর উত্তর দেওয়ার খুব প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কারণ পারমাণবিক অস্ত্র তৈয়ার করার পর মানবজাতি এই মহা প্রলয় থেকে বাঁচার কোন পথ অবশিষ্ট রাখে নাই।
১৯৬০ দশকে সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ‘নিখিতা ক্রুশ্চেভ’ তখনকার দিনে বিশ্বের সব চাইতে আকষর্ণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ঞযবৎব ধৎব ঃযড়ংব যিড় ফড়হ’ঃ ংববস ধনষব ঃড় মবঃ রহঃড় ঃযবরৎ যবধফং ঃযধঃ রহ ঃযব হবীঃ ধিৎ ারপঃড়ৎ রিষষ নব নধৎবষু ফরংঃরহমঁরংযধনষব ভৎড়স ঃযব াধহয়ঁরংযবফ. অ ধিৎ নবঃবিবহ ঃযব ংড়ারবঃ ঁহরড়হ ধহফ ঃযব টহরঃবফ ঝঃধঃবং, ড়িঁষফ ধষসড়ংঃ পবৎঃধরহষু বহফ রহ সঁঃঁধষ ফবভবধঃ.’ অর্থাৎ কিছু লোকের মাথায় আসেনা যে ভবিষ্যৎ যুদ্ধে বিজয়ী ও পরাজিতের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবেনা। যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েট ইউনয়নের মধ্যে যুদ্ধ হলে সুনিশ্চিতভাবে উভয়েরই পরাজয় হবে। ৬০ দশকে যদি বিশ্বে এই অবস্থা বিরাজ করে থাকে তাহলে বর্তমানে বিশ্ব কি অবস্থায় আছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

লেখক : কলামিস্ট