সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, প্রবাসীর স্ত্রী এবং একজন প্রেমিকের করুণ পরিণতি

113

এমরান চৌধুরী

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একটি স্পর্শকাতর তথা সেনসেটিভ মাধ্যম। এর মধ্য দিয়ে আমরা যেমন বিনোদনের সকল উপাদান পেয়ে থাকি, তেমনি এই মাধ্যমটির অন্তরে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এমন কিছু বিষয় যা মুহূর্তে সমাজকে করে তুলতে পারে বিষিয়ে। সৃষ্টি করতে পারে নৈরাজ্য। উসকে দিতে পারে ব্যক্তি বিভেদ।এতদিন ধরে রাখা কারও ব্যক্তিগত সুনামে নামাতে পারে ধস। দিতে পারে অভাবিত ধাক্কা। তাই এই মাধ্যমটি যাঁরা ব্যবহার করেন তাঁদের হতে হয় যথেষ্ট সহনশীল, ধীরস্হির প্রকৃতির। তা না হলে এই মাধ্যমটি আপনার মনের প্রশান্তির বদলে অশান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে আমাদের কেন জানি মনে হয় ফেসবুক মানুষের তথা মানবজাতির যতটা উপকার করে ঠিক ততটাই ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে।
ফেসবুক অবাধ হওয়ার আগে সমাজ-সংসারে এতটা অস্বস্হি, এতটা টেনশন, এতটা ভোগান্তি ছিল না। কার ছেলে কোন মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলল, কোন ভঙ্গিমায় ছবি তুলল তা দেখা দূরে থাক জানারও কোনো সুযোগ ছিল না। আর এখন আপনার মেয়েটি না চাইলেও, ঘোর আপত্তি থাকলেও সেলফি নামক মারাত্মক মারণাস্ত্রের কাছে হার মানতে হচ্ছে। পরবর্তীতে ছবিটি যখন ফেসবুকে দেওয়া হয় তখন নানাজন নানা চর্চায় মুখর হয়ে ওঠে। কেউ হয়তো আগ বাড়িয়ে বলে বসেন দেখেছেন অমুক বাড়ির মেয়েটার কাÐ জাইল্লার ছেলের সঙ্গে কেমন বেশরমভাবে ছবি তুলেছে। এই নিয়ে শুরু হয় কানাকানি। এক সময় মেয়েটি ও তার পরিবারে নেমে আসে চরম অশান্তি। এই গেল একটা দিক। অন্যদিকে একটা মানুষের মৃত্যু সংবাদ পেতে অনেকটা সময় লাগত। অন্তত অতটুক সময় মানুষ স্বস্হিতে থাকত। যদিও প্রবাদ আছে, দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ধায়।এখন একটা মানুষ মারা গেলে, অসুস্হ হলে তাঁর সংবাদ শেয়ার করার পাশাপাশি মৃত বা অসুস্থ ব্যক্তির ছবিও দেওয়া হয়। যারা দেন তারা হয়তো আবেগের বশে দেন। কিন্তু তাদের একটা কথা মনে রাখা উচিত সবার কলিজার সহনশীলতা এক নয়। কোনো কোনো মানুষ খুন করে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমাতে পারে। আবার কোনো লোক খুন করার পর এমন অস্হিরতায় ভোগে যে সে খুন করেছে কথাটা স্বীকার না করা পর্যন্ত স্বস্হি পায় না। তাই ফেসবুকে ছবি দেওয়ার সময় মনে রাখতে হবে, ফেসবুক অবসর ও বিনোদনের মাধ্যমও। কিশোর-কিশোরী থেকে অশীতিপর মানুষ সবাই না হলেও প্রতি তিনজনের দুইজন ফেসবুকে বুঁদ হয়ে থাকে। এসব মানুষের মধ্যে দুর্বল, অসুস্হ, মারাত্মক অসুস্হ, চিন্তিত, টেনশনে ভোগা অনেকেই থাকেন যাঁরা মৃত মানুষের ছবি, মৃত্যুর সংবাদ দেখতে অভ্যস্ত নন। সুতরাং আবেগের বশে, নিজের খেয়ালখুশির বশে এমন কোনো কাজ করা উচিত নয় যার দ্বারা অন্যের রোগশোক বেড়ে যেতে পারে।
ফেসবুকে কিছু একটা রটিয়ে দিলে পলকে তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে আর কান নিয়েছে চিলের মতো কোনো বাছ বিচার ছাড়াই তার পেছনে ছুটতে থাকে অগণিত মানুষ। ফলশ্রæতিতে অনেক মিথ্যাকেও অনেকে সত্য বলে ভ্রম করে। তাই দেখা যায় মুরগির সীমানা ডিঙানোর মতো ফেসবুকের পোস্ট নিয়েও অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি হয়। এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকে প্রতিদিন অগণন বিষয় শেয়ার করা হয়। এতে বিচিত্র, বর্ণিল বিষয় যেমন থাকে, পাশাপাশি দুঃখ, ব্যথা-বেদনায় ভারাক্রান্ত পোস্টও থাকে, থাকে রাজনীতি, অর্থনীতি, হাসি-কৌতুক, বিনোদন, ধর্মের অপব্যাখ্যা, ওয়াজ-নসিহত ইত্যাদি। অন্যদিকে কবি সাহিত্যিকদের সরব উপস্হিতি, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ছড়া-কবিতার প্রচারতো আছেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া সব পোস্ট সবার ভালো লাগার কথা নয়। ভালো লাগবে এমন নিশ্চয়তা কখনো কেউ দিতে পারে না। এরপরও কিছু কিছু পোস্ট মানুষকে সচেতন করে। কিছু পোস্ট মানুষের ভাবনার জগতকে প্রসারিত করে। কিছু কিছু পোস্টের সুবাদে মানুষের কিছু সমস্যার সমাধানও হয় এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। যেমন ধরা যাক কোনো মুমূর্ষু রোগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাড়া পড়ে অনেক রক্তদাতার। সন্ধান পাওয়া যায় সঠিক রক্তদাতার। হোক না রেয়ার গ্রæপের রক্ত। হোক ও নেগেটিভ। এভাবে ফেসবুকের কল্যাণে অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয় অনেকটা অনায়াসে।
এরকম আশা জাগানিয়া পোস্টের পাশাপাশি অনেক হৃদয় ভাঙার পোস্টও আমরা দেখতে পাই। কয়েকদিন আগে একজন সহজ সরল মানুষের করুণ পরিণতির পোস্ট দেখলাম। যা পড়ে যেকোনো পুরুষ মানুষের মুহূর্তে স্ত্রী নামক মানুষটির ওপর বিশ্বাস উঠে যেতে পারে জীবনের জন্য। আলকরণ এলাকার এক ব্যক্তি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন চট্টগ্রামের বাইরের এক মেয়েকে। মা-বাবার অমতে বিয়ে করার ফলশ্রুতিতে অভিভাবকেরা তাঁদের বিয়ে মেনে নেননি। শেষে বাধ্য হয়ে শহরের কোনো এক জায়গায় বাসা ভাড়া করে থাকতে শুরু করে। ভালোবাসার বিয়ে বলে কথা। লোকটি স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ভালোবাসায় সুখের নহর বইয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে এক সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দেন। চাকুরি এবং ব্যবসা করে অনেক টাকা পয়সা রোজগার করেন আর সমুদয় অর্থ পাঠাতে থাকেন স্ত্রীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এক সময় জায়গা কিনেন কাজির দেউড়ি এলাকায়, বাড়ি বানান। পরিবারে আসে একে একে তিন সন্তান। আসে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য। সুখ যখন উপচেপড়া শুরু করে তখন তিনি দেশে ফিরে আসেন।
দেশে ফিরে পরিবারের সঙ্গে বসবাস শুরু করেন তিনি। কিন্তু বছর না গড়াতেই স্ত্রীর সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য। লোকটির সারা জীবনে নিরন্তর শ্রম আর ঘামে উপার্জিত সব সম্পদই ছিল স্ত্রীর নামে। বাড়ি-গাড়ি, ব্যাংক-ব্যালেন্স সব। এসবের গরমে স্ত্রী নিজের এক সময়ের প্রেমিক, প্রাণপ্রিয় স্বামীকে কদর কিংবা সেবাযতœ করাতো দূরের কথা নানাভাবে অপদস্ত করা শুরু করে। এক সময় প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নিজের স্বামীর নামে ঠুকে দিল যৌতুকের মামলা। মিথ্যা যৌতুকের মামলায় তিনি জেলে কাটান বেশ কয়েক বছর। জেল থেকে বের হয়ে আপন ঠিকানায় ফিরে এসে দেখেন তাঁর কেউ নেই। স্ত্রী বাড়িঘর বিক্রয় করে ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় চলে গেছে। পড়শিদের কেউ তাদের হদিস দিতে পারল না। এই কথা জানার পর লজ্জায় ঘৃণায় তিনি আর পৈত্রিক বাড়ি আলকরণ কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যাননি। ঠাঁই নেন পৃথিবীর সব মানুষের ঠাঁইয়ের জায়গা পির আউলিয়ার মাজারে মাজারে।
এভাবে এই কদিন আগে তিনি মারা যান নিতান্ত দীনবেশে শাহ আমানত শাহ হুজুরের মাজারের কাছে। মৃত্যুর পর তাঁর পকেটে পাওয়া আইডি কার্ডের সূত্র ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় বিষয়টি। এ ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও সবার অন্তরে নাড়া দিয়েছে দারুণভাবে। বিশেষত প্রবাসীদের কাছে এ ঘটনা চিন্তা ও কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। প্রত্যেক স্বামীই তাঁর স্ত্রীকে পরমভাবে বিশ্বাস করে। কারণ একজন পুরুষ ও একজন নারী মিলেই সংসার। সংসারের উন্নতি ও ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে কারও ভূমিকা কম নয়। একজন রাতদিন পরিশ্রম করে অর্থ উপার্জন করেন, আরেকজন সংসারের নৈমিত্তিক কাজকর্ম সামাল দিয়ে পরিবারটিকে ফলবান বৃক্ষে পরিণত করেন। এ ব্যাপারে সংসারে পরস্পরের মধ্যে নিবিড় বিশ্বাস থাকতে হয়। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় সংসার নামক তাজমহল। কিন্তু কখনো কখনো অর্থের কাছে, বিত্তের কাছে স্বামীর কাছে স্ত্রী, স্ত্রীর কাছে স্বামী চরম অবহেলার শিকার হয়। সেই অবহেলা অনেক সময় ডেকে আনতে পারে করুণ পরিণতি। যেমনটা ঘটেছে আলকরণের মানুষটির।
এই ঘটনা সমাজে, পরিবারে নিত্য ঘটমান হাজারো ঘটনার একটি তাতে সন্দেহ নেই।শতকরা হিসেবে ঘটনাটি নগন্য ও ক্ষুদ্রতম হলেও কোনোমতে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ইতিপূর্বে প্রবাসীর টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়ে নিজের স্ত্রীর নিরুদ্দেশ হওয়া কিংবা পুরানো প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার কথা পত্র পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি করোনাকালীন স্বামী বিদেশ থেকে ফিরছে শুনে স্ত্রী পালিয়ে গেছে। কেন এমনটা ঘটছে? সংখ্যার বিচারে ঘটনাগুলো খুবই বিচ্ছিন্ন হলেও সামাজিক অবক্ষয়ে এটি একটি মাত্রা সংযোজন করেছে তাতে সন্দেহ নেই। আমরা সবাই জানি অর্থ যত অনর্থের মূল। মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু যাঁরা পড়েছেন তাদের নিশ্চয় জানা আছে অর্থ কত ভয়ানক অনর্থের মূল হতে পারে। এই ঘটনা পারিবারিক বন্ধন ও বিশ্বাসের ওপর চরম আঘাত। ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন হলেও প্রবাসীদের অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে নতুন করে সচেতন ও সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে বলে আমাদের মনে হয়।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক