সামরিক শাসক থেকে রাষ্ট্রপতি অতঃপর বিরোধী দলীয় নেতা

142

না ফেরার দেশে চলে গেলেন জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে ১৪ জুলাই ২০১৯ খ্রি. রবিবার সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে মৃত ঘোষণা করে(ইন্না রাজিউন)। মৃত্যুর পূর্বে প্রায় ১০ দিন তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। জনাব হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একজন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তাঁর স্ত্রীর রওশন এরশাদ ১১তম মহান জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা। অপর স্ত্রী বিদিশা। এরশাদের দুই স্ত্রীর দুই ছেলে ছাড়াও ২টি দত্তক সন্তানও রেখে গেছেন। অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে প্রায় ৮ বছর বাংলাদেশ শাসন করেন তিনি। জানা যায় রওশন এরশাদের পূর্বেও তিনি একটি বিয়ে করেছিলেন। যাক সেসব কথা। জনাব এরশাদ সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালীন ১৯৮৩ সালে তার স্ত্রী রওশন এরশাদের পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়। তার এ সন্তানের নাম রাহগির আলমাহি এরশাদ (শাদ এরশাদ)। নানা বিতর্কের জন্ম দেয়া শাদ এরশাদ বাংলাদেশেই আছেন। জেনারেল এরশাদের দ্বিতীয় ছেলে এরিক এরশাদ বর্তমানে তার ১৮ বছর বয়স। সাবেক এ রাষ্ট্রপতির বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে বাবার সাথে থাকতেন। এরিকের মা বিদিশা। ২০০৫ সালে এরশাদের সাথে বিদিশার সম্পর্কের বিচ্ছেদ হয়। জনাব এরশাদের পালিত পুত্র ২৫ বছর বয়সী আরমান এরশাদ থাকেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে। তার একমাত্র পালিত কন্যা জেবিনের বিয়ে হয়েছে। ৩৫ বছর বয়সী জেবিন লন্ডনে বসবাস করেন। এ হল জেনারেল এরশাদের পারিবারিক পরিচিতি। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এবং একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কর্মজীবন শুরু করেছিলেন পাকিস্তান সেনাবহিনীতে। তবে তার জন্ম ১ ফেব্রæয়ারি ১৯৩০ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে। ভারত ভাগের পর তার পরিবার চলে আসে বাংলাদেশের রংপুরে। তার ডাক নাম পেয়ারা। জনাব এরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তিনি পাকিস্তানে ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসে নানা তদবিরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে সক্ষম হন। এ সময় তার পদমর্যাদা ছিল কর্নেল। ১৯৭৫ সালে এরশাদ ভারতের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে প্রতিরক্ষা কোর্সে অংশ নিতে গিয়েছিলেন।
ওই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে শহীদ করা হয়। এ সময়ও এরশাদ ভারতে ছিলেন। ওই নির্মম হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসা জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ার পর তার উদ্যোগে ভারত থেকে এনে এরশাদকে সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ও মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে সেনাপ্রধান করেন ।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যূত্থানে জিয়া নিহত হন। সেই সময় এরশাদই কলকাঠি নেড়েছিলেন বলে জিয়ার স্ত্রী ও বিএনপি’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার অভিমতে পাওয়া যায় । যা হউক ওই ব্যর্থ অভ্যূত্থানের নেতা মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরকে তখন হত্যা করা হয়। সেই হত্যার মামলা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এরশাদকে বইতে হয়েছে। জিয়া নিহত হওয়ার পর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন এরশাদ। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। নিজেকে সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করেন তিনি। স্থগিত করেন সংবিধান। প্রথমে বিচারপতি এ এফ এম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছিলেন এরশাদ। কিন্তু সব ক্ষমতা ছিল এরশাদের হাতে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এরশাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ ছিল না রাষ্ট্রপতির। মাত্র এক বছর পর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এ এফ এম আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসেন এরশাদ।
তিনি ক্ষমতায় বসে তার গুরু জিয়াউর রহমানের পথ অনুসরণ করে প্রথমে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে উঠে, যা ছিল এরশাদের রাজনীতিতে নামার প্রথম ধাপ। এরপর বিএনপি, আওয়ামী লীগ সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে নেতা সংগ্রহ করে এরশাদ গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় পার্টি’। মৃত্যু পর্যন্ত এই দলটির একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতেই। এরশাদ প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষ্যে উপজেলা গঠন করে প্রথম নির্বাচনের পরীক্ষায় নামেন। উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রায় সব উপজেলায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। উপজেলা নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন দিয়ে নিজের ক্ষমতা দখলকে জায়েজ করেন এরশাদ। এরপর ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেন। এ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এ নির্বাচন ছিল বিতর্কিত নির্বাচন। ভোটার বিহীন নির্বাচন। এসময় স্বৈরশাসন থেকে মুক্তির গণ আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯৮৩ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তীব্রতা পায়। সেই সময় ছাত্র আন্দোলন ও বিক্ষোভে ভিত এরশাদের পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে রাজপথে প্রাণ হারান জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহাসহ বহু নেতাকর্মী। ১৯৮৪ সালে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের ট্রাক তুলে দিয়ে হত্যা করে ছাত্রনেতা সেলিম দেলোয়ার ও রাউফন বসমিয়াকে। এরশাদের দমন আর নির্যাতনের মুখে ছাত্র আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে। এছাড়া শ্রমিক পেশাজীবীরা আন্দোলনে নামে। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জনতার আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। শেখ হাসিনার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেয়ার পর আন্দোলন আরও গতি পায়। আন্দোলনের মুখে ১৯৮৬ সালের সংসদ ভেঙে ১৯৮৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিলেও জননেত্রী শেখ হাসিনা সহ সবদল একযোগে সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। নূর হোসেনের আত্মদান গণতন্ত্রের ইতিহাস এক মাইলফলক। ১৯৯০ সালের গণ অভ্যূত্থানে স্বৈরাচার পেছনে হটতে বাধ্য হন। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম মিলন ও ছাত্রনেতা নাজির উদ্দিন জেহাদ এর রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। এ আন্দোলনের তীব্রতায় সেনাবাহিনী এরশাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে। ফলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। আন্দোলনরত জোটের নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনার রূপরেখায় সর্বসম্মতিক্রমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষণা আসে। এ সরকারের প্রধান করা হয় তৎকালিন প্রধান বিচারপতি মোঃ সাহাবুদ্দীন আহমদকে। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রæয়ারিতে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে জয়লাভ করে (বিএনপি) বাংলাদেশ জাতীয়বাতাদী দল। প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আসন ছিল ৮৮টি এবং পতিত এরশাদের জাতীয় পার্টি ৩৫টি আসন লাভ করে ৪র্থ রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পায়। এ সময় বিএনপি’র সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ ১০টি অভিযোগ আনে। কারাগারে তাকে বহু বছর দুঃখ যন্ত্রণা পোহাতে হয়। এরশাদ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভাল কাজ করলেও খারাপ কাজও কম নয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, সংবিধানকে বিকৃত করাসহ নির্যাতনের পথে ছিলেন এরশাদ। তাকে নানাভাবে ব্যবহার করা হয়েছে রাজনীতির মাঠে। পল্লীবন্ধু খ্যাত এরশাদ গ্রামের উন্নয়নে ইউনিয়ন পরিষদকে অধিক শক্তিশালী করারও চেষ্টা করেন। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় এদেশের মানুষদের মধ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। এসময় এরশাদ বিপর্যস্ত মানুষের পাশে ছিলেন। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বিচিত্র চরিত্রের এক মানুষ। তিনি ক্ষমতার লোভে মানুষ হত্যা, জেল-জুলুম নির্যাতন চালিয়েছেন, কবিতা ও গান গেয়ে মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছেন। তবে আমার রাজনৈতিক জীবনে এরশাদের সময় ছিল দুর্বিষহ। রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি। বার বার মিথ্যা মামলায় জড়ানো, অপহরণ ও চাকুরীতে হয়রানিসহ নানামুখি নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও বলবো এরশাদ দুর্বল মনের মানুষ ছিলেন। তার মধ্যে ভয়-ভীতি কাজ করতোÑতাই তিনি কথায় ও কাজে মিল রাখতে পারেননি। তার দুর্বলতার সুযোগে তার দল ও শরীক অন্যরা নানাভাবে সুযোগ নিয়েছে এবং তাকে ব্যবহার করেছে যার যার মত করে।
ইতিহাসে বহু সামরিক কর্তা ও স্বৈরশাসকদের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে যাদের ক্ষমতা ভোগের পর হয়ত কারাবাসেই জীবন শেষ হয়েছে, না হয় ঘাতকের বুলেটে জীবনাবসান ঘটেছে, অথবা দেশের বাইরে পালিয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এরশাদ? তার বহুমাত্রিক শোষন, শাসন ও রাজনৈতিক জীবনের কাহিনী শেষ হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যুর মাধ্যমে, স্বদেশে এবং ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে। তার ইতিহাস অনেকটা মধ্যযুগীয় সুলতানী বা মোঘল ইহিাসের ন্যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকবে। এরশাদ দেশের সকলের কাছে জনপ্রিয় না হলেও নিজ জন্মভূমি রংপুরের সোনার ছেলে ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তার শাসনে রংপুর যে যত্ন পেয়েছিল, রংপুরবাসী তা ক্ষণিকের জন্যও ভুলে নি। তাদের দাবি ও আর্তনাদে সর্বশেষ ঢাকার বনানীর সেনানিবাসের কবরস্থান বাদ দিয়ে এরশাদকে সমাহিত করা হয়েছে রংপুর পল্লীনিবাসে তাঁর বাবার কবরের পাশে নিজ জেলায়। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক