সান্ধ্য কোর্স চালু রাখতে ঢাবির সভায় তুমুল বিতন্ডা

25

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু রাখতে এককাট্টা হয়েছেন শিক্ষকদের একটি বড় অংশ। গত সোমবার একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বিষয়টি নিয়ে এর পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বিতর্ক হয়। তবে শেষ পর্যন্ত এসব কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ সব ধরনের কার‌্যক্রম আগামী পাঁচ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করা হয়।
সান্ধ্য কোর্স পর্যালোচনা ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটি ওই সময়ের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দেবে, সেটি পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান।
সভার পর তিনি বলেন, কমিটি আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দেবে। কিন্তু এই পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে এসব অনিয়মিত কোর্সে কোনো ধরনের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি, প্রেস, ইনটেক করতে পারবে না। এর মধ্যে যারা বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেগুলো স্থগিত থাকবে। আর যে কোর্সগুলো চলমান আছে, সেগুলোর বিষয়ে কিছু করার নেই, সেগুলো চলবে। তারপর প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেটা একাডেমিক কাউন্সিলে যাবে। সেখানে জাতীয় চাহিদা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা বিবেচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। খবর বিডিনিউজের
আগামী পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে কোর্স পরিচালনার একটি সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদকে প্রধান করে ১৮ সদস্যের কমিটিও করা হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্স নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কড়া সমালোচনার পর গত বছর ২৭ মে এসব কোর্সের যৌক্তিকতা যাচাই ও পর্যালোচনার জন্য ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের পাঁচজন ডিনের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক তোফায়েল আহমদ চৌধুরীকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।
ওই কমিটি আট মাসেরও বেশি সময় পর্যবেক্ষণ শেষে গত ৯ ফেব্রূয়ারি এসব কের্সের বিষয়ে একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের সুপারিশ করে উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন। আর নীতিমালা প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত এসব কোর্সে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি সাময়িক বন্ধ রাখারও সুপারিশ করে কমিটি।
কমিটির ওই প্রতিবেদনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের কয়েকটি বিভাগ তড়িঘড়ি করে সান্ধ্য কোর্সে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।
কমিটির সুপারিশ : ক. সান্ধ্য কোর্স চালু করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা ইনস্টিটিউটের নিজস্ব সামর্থ্য (শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা, ভৌত অবকাঠামো, লাইব্রেরি ও আনুষাঙ্গিক বিষয়) বিবেচনা আনতে হবে। খ. ইনস্টিটিউটে অনার্স ও মাস্টার্স চালু থাকায়, তাদের সামর্থের মূল্যায়ন করা। গ. এ ধরনের প্রোগ্রামে লোকবল নিয়োগের প্রয়োজন হলে (পদসৃষ্টি) ইউজিসির অনুমোদন আবশ্যক। ঘ. ভর্তি প্রক্রিয়া, পাঠদান, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও মূল্যায়ন এবং সনদ ইস্যু ইত্যাদি ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ঙ. এসব কোর্সের কারণে নিয়মিত কোর্স, গবেষণা কার্যক্রম ও আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক র‌্যাংকিং প্রভাবিত হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়ন। ছ. আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরুপণ। জ. সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রামের শিক্ষকদের সম্মানীর হার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রোগ্রামের হারের সাথে যুক্তিসঙ্গত পর্যায়ে আনয়ন। ঝ. ‘ক’ থেকে ‘জ’ পর্যন্ত বিষয়সমূহ বিবেচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা পর্যন্ত বিদ্যমান সান্ধ্যকালীন ও পেশাগত অনিয়মিত কোর্স সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা আবশ্যক।
সোমবার একাডেমিক কাউন্সিলের সভার আলোচনায় সান্ধ্য কোর্স চালু রেখে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে মত দেন অধিকাংশ শিক্ষক। সভায় বেলা তিনটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দীর্ঘ সাত ঘণ্টা এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়।
সভায় একাধিক অধ্যাপক সান্ধ্য কোর্সের পক্ষ নিয়ে বলেন, একই সমমানের যারা অন্যান্য পেশার তুলনায় তাদের বেতন অনেক কম। সান্ধ্য কোর্স চালু থাকলে শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা হয়।
সান্ধ্য কোর্স সাময়িক স্থগিতের বিষয় চারজন ডিন একমত পোষণ করলেও সান্ধ্য কোর্স পর্যালোচনা ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির সদস্য ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন শিবলী রুবায়াইতুল ইসলাম এসব কোর্স চালু রেখে নীতামালা প্রণয়নের কথা বলেন। নতুন নীতিমালা প্রণয়ন পর্যন্ত প্রোগ্রামগুলো স্থগিত রাখা হলে ছাত্র-শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন তিনি।
সান্ধ্য কোর্সের পক্ষ নিয়ে অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জিয়া রহমান বলেন, এ ধরনের প্রোগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে। আমি যদি আমার বিভাগের কথা বলি তাহলে বলব, আমার এখানে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসে, যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে গৌরাবান্বিত করে।
সভায় সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে কোরাম তৈরি করে বিপক্ষের শিক্ষকদের কথা বলা সুযোগ দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন কমিটির আহ্বায়ক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তোফায়েল আহমদ চৌধুরী।
কোর্সের বিরোধিতা করে স্যার এ এফ রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম, আমাদের নিয়মিত শিক্ষার্থীরা, যারা মেধা দিয়ে এখানে ভর্তি হয়, তাদের স্বার্থের বিষয়ে আমাদের চিন্তা করতে হয়। শিক্ষার্থীরা অনেকেই অভিযোগ করেছে, শিক্ষকরা তাদেরকে সময় দেন না।
অন্যদিকে সভায় সান্ধ্য কোর্সের পক্ষে কথা না বলায় কিছু শিক্ষকের তোপের মুখে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ এস এম মাকসুদ কামাল।
সভা শেষে ফেরার পথে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের অর্গানাইজেশন স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মাদ আব্দুল মঈন মৌখিকভাবে তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করলে মাকসুদ কামাল গাড়ি থেকে নেমে আসেন। সে সময় ১৫-২০ জন শিক্ষক মাকসুদ কামালকে ঘিরে ধরেন। পরে দুইজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
সান্ধ্য কোর্স পর্যালোচনা ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স আছে।
মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, ট্রেনিং কোর্সসহ অনিয়মিত এসব কোর্সের সংখ্যা ৬৯। এর মধ্যে ৫১টি মাস্টার্স, চারটি ডিপ্লোমা, সাতটি সার্টিফিকেট আর সাতটি ট্রেনিং কোর্স।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের বাইরে ১০৫টি ব্যাচে এসব কোর্সে বছরে সাত হাজার ৩০২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাদের ক্লাস নেন ৭২৫ জন শিক্ষক।
সবচেয়ে বেশি সান্ধ্য কোর্স আছে ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। এই অনুষদের নয়টি বিভাগের প্রতিটিতেই সান্ধ্য কোর্স আছে। এসব কোর্সে প্রতিবছর ৪৫টি ব্যাচে দুই হাজার ৯৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। ক্লাস নেন ২৩০ জন শিক্ষক।