সাধারণ মানুষের আস্থার

58

সবাই একমত হবে যে, দেশের আর্থিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকার সম্ভব সবকিছুই করছে। বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মত দুঃসাহস দেখিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত সরকার। এতসব অর্জনের মধ্যেও সরকার ও সাধারণ মানুষের হতাশা দুর্নীতির ঘোড়দৌড় বন্ধ করতে না পারা। এ না পারার বহু কারণের মধ্যে অন্যতম একটি দুর্নীতির কারণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত ও নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা। এছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে গেলে সবার আগে দরকার রাজনৈতিক অঙ্গীকার। কারণ বিষয়টি মুখ্যত সরকারের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভরশীল। সেই দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখেই নীতিমালা ও কর্মকৌশল এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্রিয়তার পরিসর নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ সংস্থাগুলোর অগ্রাধিকার ও সক্রিয়তার মাত্রা নির্ভর করে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে প্রতিটি কাজের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। সংস্থাগুলোর এখতিয়ারের বিধিমালা নির্ধারণ করাই আছে। সে অনুযায়ীই তারা কাজ করবে। উপরন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর পরিচালকগণ স্বাধীনতা বিধিবলে নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু তারা কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়। তাই আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে উন্নয়নের রোলমডেলে পরিণত হওয়ায় বাংলাদেশকে আরো স্বচ্ছভাবে তুলে ধরতে হলে নতুন সরকারের দুর্নীতি বিরোধী অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। আর দুদককে তা দ্বিধাহীনভাবে কার্যকর করতে হবে।
একদশক আগের ইতিহাসে নজর দিলে দেখা যায়, দুর্নীতি দমন বিষয়ক শীর্ষ সংস্থার কার্যক্রম সবসময় তাদের সীমারেখা মেনে চলেনি। বা তাদের স্বাধীন সত্তাকে সত্যিকার অর্থে কার্যকর করে নি। ফলে তারা প্রায় রাজনৈতিক তথা সরকারি হস্তক্ষেপের শিকার হয়েছে, বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের শাসনামলে। এমনকি কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলেও তার বিরুদ্ধে মামলা বা তদন্ত করা যাবে কিনা-তা নিয়েও সরকারের ইশারা-ইঙ্গিতের প্রতি মুখিয়ে থাকতে দেখা গেছে এ সংস্থাটি। জনমনে এ ধারণা জন্মেছিল যে সংস্থাটি কার্যত দুর্নীতির রাঘববোয়ালদের রক্ষক। ২০০৮ সালের পর সংস্থাটিতে লক্ষণীয় কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এটিকে এখন সক্রিয় ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানই মনে হয়, তবে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অভ্যন্তরীণভাবে পরিপূর্ণ সমন্বয় এখনো দেখা যাচ্ছে না বলে আমাদের মনে হয়। কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হতে হলে প্রয়োজন কাজের সমন্বয়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্তপূর্বক মামলা দায়ের করা এবং তা দ্রæত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া। নতুন বছরের শুরুতে দুদকের প্রকাশিত বিদায়ী বছরের মামলাসংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দৈনিক পূর্বদেশে বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে অভিযান পরিচালনা এবং মামলায় অভিযুক্তদের সাজা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সাফল্য পেলেও বিদায়ী বছরে তদন্তাধীন মামলার চার্জশিট দাখিল ও বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতাশার বার্তাই দিয়েছে দুদক। যদিওবা দুদক দাবি করছে অভিযোগ গ্রহণ থেকে শুরু করে মামলা নিষ্পত্তি পর্যন্ত ধারাবাহিক ধাপগুলোতে বিরাজমান দীর্ঘসূত্রতাজনিত সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার কাজ আরও আগেই শুরু করা হয়েছে। তাদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারসহ নানাক্ষেত্রে দুদক যেমন তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি আমাদের চলমান কার্যক্রমে দুদক সম্পর্কে মানুষের মনে প্রচলিত ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। হয়তো নানাক্ষেত্রে প্রত্যাশিত মাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে, কারণগুলো চিহ্নিত করে প্রতিবন্ধকতা দূর করারও চেষ্টা চলছে। নানা খাতে রাষ্ট্রে প্রচলিত বিধিবিধানের মতই দুর্নীতি দমনেও আমাদেরকে বিদ্যমান আইন ও বিচারব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে হয়। তবে, দুদক অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথেই হাঁটছে।’ অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী কর্মপরিকল্পনা অনুসরণ করে দুদক বিদায়ী বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে জনগণের আস্থা অর্জনে অভিযান জোরদার করা ও দুর্নীতির উৎস বন্ধে ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশ বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী হয়েছে। এছাড়া, এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে ফাঁদ পেতে ঘুষখোর ধরা ও সচেতনতা তৈরিসহ প্রতিরোধের বিভিন্ন কাজে সারাবছরই নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে সংস্থাটি।
আমরা দুদকের এ অগ্রসরতাকে অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য বলে মনে করি। তবে মামলা ও তদন্তের জটের কাছে সব অর্জন অদৃশ্যই থেকে যেতে পারে সেই বিষয়গুলোর প্রতিও দুদককে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশে সুযোগ সন্ধানীর অভাব নেই। দুদকের অভিযানের সুযোগে সুযোগসন্ধানীদের নানা কৌশলে অনেক নিরীহ ও ধরাসায়ী হতে পারে। এ বিষয়েও দুদককে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা চাই এ প্রতিষ্ঠানটি সাধারণ মানুষের আস্থার ঠিকানা হোক। দেশ দুর্নীতিমুক্ত হলে বিশ্বে উন্নত শিরে দাঁড়াতে কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না।