সাধক কবি সুধীর চৌধুরী অধ্যাপক শ্রী স্বদেশ চক্রবর্তী

88

সুধীর চৌধুরী একাধারে যোগী, সাধক কবি, সুর স্রষ্টা, সঙ্গীত শিল্পী, মৃদুভাষী, ভাবগম্ভীর, অথচ হাস্যরসিক, ক্রীড়ামোদী, উপরন্তু স্নেহপ্রবণ। তাঁর নানামুখী প্রতিভার দীপ্তি বিকীর্ণ হয়েছে এসবের মধ্যে। অন্তর গহনে তিনি ছিলেন নিভৃতচারী কলাকোবিদ, প্রাত্যাহিকতার অন্তরালে আপনাকে ঢেকে রেখেছেন; কিছুটা যেন নাগালের বাইরে আত্মপ্রচারে পরান্মুখ। অসংখ্য লেখা তাঁর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীর পাতায়। বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের ফুল মনের আনন্দে তিনি ফুটিয়েছেন নিখিলের মর্মস্থলে। আপনার মনের মাধুরী মিশায়ে আপন মনে গান গেয়ে গেছেন। শ্রীঅরবিন্দের প্রবচনে আছে, চেতনা যখন মনের ভূমি পার হয়ে উত্তরমানসে উপনীত হয় তখন সৃজনক্ষম প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। সুরলোকের সৌন্দর্য সুধার সঞ্চার ঘটে তার অনুভবের ভৃঙ্গারে। মর্ত্যরে মর্মে সে হয় নন্দনবনের মালাকার।
১৯১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার কধুরখীল গ্রামে সাধক কবি শ্রী সুধীর চৌধুরীর জন্ম। পিতা শশী কুমার চৌধুরী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শশী মাস্টার। শৈশবে সুধীরের ডাক নাম ‘সোনা’। পিতার চার পুত্রের মধ্যে সুধীর তৃতীয়। অগ্রজ সুধাংশু, সুখেন্দু, কনিষ্ঠ অধীর। সঙ্গীতচর্চা ও অনুশীলন এই পরিবারের ঐতিহ্যের অন্তর্গত। গোমদÐী প্রাইমারি স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ। এই কৈশোরেই বড় ভাই সুধাংশু বিমলের কাছে সুধীর সঙ্গীতের তালিম নেন। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে কধুরখীলের সন্তান যতীন্দ্র লাল চৌধুরীর কাছে শোনেন শ্রীঅরবিন্দের মধুনাম। যতীন্দ্রনাথ নাম শ্রীঅরবিন্দ প্রদত্ত।
সে নাম তাঁর কর্ণকুহরের ভিতর দিয়ে মর্মস্পর্শ করেছিল। সত্তার অণু-পরমাণুতে পরতে পরতে সে নাম মিশে গেল। তনু মন-প্রাণে, হৃদয় তন্ত্রীতে অনুরণিত হতে থাকল অনুক্ষণ। মধু বৃন্দাবনে যমুনা পুলিনে রাধা নামের সাধা বাঁশি অহর্নিশি বাজে। সংসারের আন্ কাজে নিরবধি ব্যস্ত বর্হিমুখী মন বাঁশির ডাক শোনে না, শুনতে চায় না। তবুও আচম্বিতে কচিৎ কখনো সে সুর লহরীর মধু মূর্চ্ছনা কারো শ্রবণে পশে যখন, মাধবের সঙ্গে মিলনের জন্য সে তখন উষ্মন, ব্যাকুল, অধীর হয়ে উঠে।
১৯৩৫ সালে সুধীর দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আর্থিক অসচ্ছ্বলতার কারণে হয়তো তাঁর উচ্চতর শিক্ষালাভের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গৃহ-শিক্ষকতার কাজ বেছে নেন এবং সঙ্গে চলতে থাকে মুদ্রাক্ষরিকের শিক্ষানবিশী। পণ্ডিচেরীর টানে তাঁর যোগাযোগ ঘটে মধ্যম শাকপুরা গ্রামের ‘সাধন বাড়ির’ সাথে। শৈল কিরীটিণী সিন্ধু-মেখলা ভূধর স্তনী রম্য চট্টলার অনেক সাধক শ্রীঅরবিন্দ-শ্রীমার প্রতি অন্তরের আকর্ষণে সমবেত হন এই সাধন বাড়িতে। পরবর্তীকালে এই ‘সাধন বাড়িই’ পরিণত হয় শ্রীঅরবিন্দ মাতৃ-মন্দিরে।
সুধীর তখন প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর সজীব মনের তরুণ। বয়স মাত্র ঊনিশ বছর। আশ্রমের ফুল বাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত ছিলেন সাধক যতীন্দ্র নাথ দাস; যাঁর দেহত্যাগের পর শ্রীমা’র মন্তব্য, ‘সে সূর্যমণ্ডলে অবস্থান করছে।’ তিনিও ছিলেন কধুরখীল গ্রামের ছেলে। আশ্রম মালঞ্চ থেকে মায়ের জন্য পুষ্পচয়নের ভার পেলেন সুধীর। ইতিমধ্যে সুধীর সুরসুধাকর ব্রজের পথিক শ্রীঅরবিন্দের প্রিয় শিষ্য দিলীপ কুমার রায় এবং শ্রীমার ‘চির কিশোর কবি’ নিশিকান্তের সান্নিধ্যে আসেন। ভাগবতাত্মা দিলীপ কুমার কবি নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একমাত্র পুুত্র। সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ দেখে দিলীপ কুমার সুধীরকে স্নেহে কাছে টেনে নেন। এই মহান সঙ্গীতগুরুর কাছে সুরের সাধনায় দীক্ষা লাভ করেন সুযোগ্য শিষ্য। তারপর সঙ্গীতের ঊর্ধ্বতর আরোহণী বেয়ে গন্ধর্বলোকের অলকাপুরীতে তাঁর অনুপ্রবেশ।
ঘোর সংসারী সুধীর চৌধুরী। কিন্তু সংসারে থেকেও কবি শ্রী সুধীর চৌধুরী ছিলেন নিরুদ্বিগ্নমনা সন্ন্যাসীর মত সরল অনাড়ম্বর জীবনের অধিকারী। কারো কাছে তাঁর চাওয়া-পাওয়া ছিল না। অনুযোগও ছিল না করো প্রতি। যাপিত জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছেন হাসি মুখে। সুললিত, মর্মস্পর্শী, প্রাণের সিন্ধু তটে এক অপার্থিব ভাবের তরঙ্গ তুলে আছড়ে পড়ত। ’৮৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিনি সচল। এরপর প্রায় দশ বছর তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন। অবশেষে ১৮৮৪ সালের ১২ এপ্রিল সকাল ৭টা ১০ মিনিটে মহাভাবাবেশে অদিতি অসীমার কোলে চির নির্বাপিত হল অতি মানসের জ্যোতি সাধক কবি শ্রী সুধীর চৌধুরীর জীবন প্রদীপখানি। যেন প্রতিধ্বনিত হল-
“যাত্রীরা চলো নির্ভয়ে ঐ তমসার পরপারে-
আদিত্য-লোকে জাগর চিত্তে নাশিয়া মরণ-শঙ্কা।”
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ