সাগরে লঘুচাপের আভাস বৃষ্টি নেমে কমাবে গরম

65

ভরা বর্ষায়ও প্রকৃতিতে বৃষ্টিধারা যেন লুকোচুরি খেলছে। কোথাও ভারি বৃষ্টি আবার কোথাও গনগনে উনুনের মত তাঁতানো মনে হচ্ছে। অবশ্য সক্রিয় মৌসুমী বায়ু বিক্ষিপ্তভাবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিধারা নামিয়েছে। মধ্য আষাঢ়ে আবহাওয়ার বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে আগামী ৪৮ ঘন্টা বা দুইদিনের মধ্যে উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তার জেরে সারাদেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। আর প্রত্যাশিত বৃষ্টিধারা নেমে আসলে তাতে বাতাসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি কিংবা আর্দ্রতা কমে গরমের অস্বস্তিকর অনুভুতি থেকেও মুক্তি মিলবে বলেও মনে করছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এদিকে, ভারী বৃষ্টির কারণে নদীর পানি বেড়ে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার নি¤œাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। আবহাওয়া অধিদপ্তরও আষাঢের প্রথম পক্ষ শেষ হওয়ার একদিন আগে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত সিলেটে দেশের সর্বোচ্চ একশ’ ৩৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে। অবশ্য পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে আগের দিন থেকে প্রচারিত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা সম্পর্কিত বিশেষ প্রতিবেদনেই স্বল্পমেয়াদী বন্যার তথ্য জানানো হয়েছিল।
বিশেষ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইতিমধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দুটি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং অন্যান্য নদীর পানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারত আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও কাছাকাছি ভারতের আসাম এবং মেঘালয় প্রদেশের কিছু অংশে আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এতে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, সারিগোয়াইন, পুরাতন সুরমা, সোমেশ্বরী, ভুগাই, কংস, যদুকাটা নদীর পানি দ্রæত বৃদ্ধি পেতে পারে। তাতে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুছ পূর্বদেশকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন আমাদের দেশে আবহাওয়ার ঋতুভিত্তিক স্বাভাবিক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যে কারণে মৌসুমী বায়ু দেশের সব অঞ্চলে বিস্তার লাভ করলেও বৃষ্টিপাত হচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। খন্ডিত আকারে বৃষ্টিবাহী মেঘ যে অঞ্চল বা এলাকায় দানা বাঁধছে বৃষ্টিও হচ্ছে সেখানে। অন্যদিকে, যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে না সেসব এলাকায় তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও বাতাসে জলীয় বাষ্পের উপস্থিতি বেড়ে যাওয়ায় অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হচ্ছে। তবে, আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর জেরে দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে।’
অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে বলা হয়েছে, মৌসুমী বায়ুর বর্ধিতাংশ পূর্ব উত্তর প্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এর একটি বর্ধিতাংশ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত আছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় রয়েছে। আর পূর্বাভাসে বলা হয়, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং খুলনা ও বরিশাল বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। এ সময় সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। আর বর্ধিত পাঁচদিনের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরও বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, গতকাল শুক্রবার সিলেট ছাড়াও বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগের সব অঞ্চলেই কমবেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের কোনও কোনও জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কিছু বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগের সীতাকুÐে ২২ এবং নোয়াখালীতে সর্বোচ্চ ৬১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ ৩৬ দশমিক ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল রাজশাহীতে। আর চট্টগ্রাম বিভাগের সবকটি অঞ্চলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৩ থেকে ৩৪ দশমিক আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই উঠানামা করেছে।
এর আগে গত মে মাসের শেষদিকে প্রতিবেশি ভারতের আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ওয়েদার অব ওয়েস্টবেঙ্গল এবারের বর্ষার নির্ঘন্ট ও অর্ধশত বছরের বর্ষার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস দিয়েছিল। তাতে বলা হয়, ইন্ডিয়ান ওসিয়ানিক ডাইপোল পজিটিভ হওয়া এবং এল নিনো তীব্রতা কমে যাওয়ায় উত্তর পূর্ব ভারতের অধিকাংশ রাজ্যগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশেও এবারের বর্ষায় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেক্ষেত্রে এ বছর বর্ষায় ভারতের আসাম, মেঘালয়, মণিপুর ও ত্রিপুরার মত বাংলাদেশের চট্টগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে স্বাভাবিকের থেকে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাবে। ওয়েদার অব ওয়েষ্টবেঙ্গলের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাস অনুযায়ী, বাংলাদেশে এ বছর বর্ষায় যথেষ্ট বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে এবং কোথাও কোথাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হবে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলিতে। এর ফলে চট্টগ্রামসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো অতি ভারি বর্ষণ ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বন্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর অর্থাৎ ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণের উপস্থিতি’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, এবার কালবৈশাখী মৌসুমের দৈর্ঘ্য বাড়লেও বিদায় নিতে যাওয়া গ্রীষ্মকালজুড়ে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপদাহ বয়ে গেছে। সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণাসহ কিছু কিছু অঞ্চলে বিক্ষিপ্তভাবে কালবৈশাখীর দাপট পরিলক্ষিত হলেও সামগ্রিকভাবে তাপদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্বমহিমায় আবির্ভূত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদ-নদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কি-না তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের তিনটি নদী অববাহিকার তিনশ’ ৪৩ টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েন্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েন্ট থেকে ৫৪টি পয়েন্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।