সাগরে মৌসুমি নিম্নচাপ, ৩ নম্বর সংকেত

32

ভরা শ্রাবণের শেষদিকে এসে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি আরও ঘণীভূত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এর প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে এবং গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমূদ্রবন্দরসহ কক্সবাজার অঞ্চলকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. আবদুর রহমান খান সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে পূর্বদেশকে জানান, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং তৎসংলগ্ন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে একই এলাকায় মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এটি গতকাল মঙ্গলবার বিকেল তিনটায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে চারশ’ ৬০ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার থেকে চারশ’ ৫০ কিলোমিটার পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে দুইশ’ ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে তিনশ’ পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজ করছে এবং গভীর সঞ্চারণশীল মেঘমালা সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা, উত্তর বঙ্গোপসাগর এবং সমুদ্রবন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। মৌসুমি নি¤œচাপটির প্রভাবে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং এসব এলাকার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে এক থেকে দুই ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছ’টায় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আবহাওয়ার দৃশ্যপটে নিম্নচাপের পাশাপাশি মৌসুমি বায়ুর সর্বশেষ অবস্থানও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ, নি¤œচাপের কেন্দ্রস্থল ও বাংলাদেশ হয়ে উত্তর-পূর্বদিকে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে তা প্রবল অবস্থায় বিরাজ করছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছ’টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রাজশাহী ও ঢাকা বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী র্বষণও হতে পারে। এছাড়া, টাঙ্গাইল ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলসহ রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু তাপপ্রবাহ কিছু কিছু জায়গায় প্রশমিত হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা এক থেকে তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে। পরবর্তী দু’দিন বা ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাতের প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়েছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় দেশের সবকটি বিভাগে কমবেশি বৃষ্টিপাত হলেও দেশের সর্বোচ্চ ৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লায়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে খুলনা বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরায়। দিনের সর্বোচ্চ ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে রংপুর বিভাগের দিনাজপুরে। চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩১ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করছে।
এর আগে গত পয়লা আগস্ট আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সভাশেষে অধিদপ্তরের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ কমিটির চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, জুলাইয়ের মত চলতি আগস্ট (শ্রাবণ-ভাদ্র) মাসেও দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হতে পারে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি বর্ষাকালীন মৌসুমী লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে অন্তত একটি জোরদার হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। সম্ভাব্য এই লঘুচাপ-নিম্নচাপগুলো দেশে ভারী বর্ষণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাতে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ফের স্বল্পমেয়াদী বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে।
অধিদপ্তরের (বিএমডি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সাধারণত সারা দেশে জুলাই মাসে গড়ে প্রায় পাঁচশ’ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তবে, এবার বিদায়ী জুলাইয়ে বৃষ্টি হয়েছে ছয়শ’ ২৫ মিলিমিটার। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। যার পরিমাণ এক হাজার ১৩ মিলিমিটার। অথচ, স্বাভাবিকভাবে গড়ে জুলাইয়ে চট্টগ্রাম বিভাগে সাতশ’ ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার কথা। একইভাবে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগেও। তবে, সিলেট বিভাগ বন্যায় আক্রান্ত হলেও সেখানে গড় বৃষ্টিপাত কম হয়েছে। উজান থেকে নদীপথে নেমে আসা ঢলের পানিতেই মূলতঃ ওই বিভাগে মৌসুমের প্রথম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টির দেখা পেয়েছেন খুলনা বিভাগের বাসিন্দারাও। অথচ তার আগে গত মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) এবং জুন (জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়) পর পর দুই মাসে সারাদেশে সার্বিক বৃষ্টিপাত হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ কম। এর মধ্যে মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ২৫ দশমিক দুই এবং জুন মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৭ দশমিক সাত শতাংশ কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জুলাই মাসে বর্ষার মৌসুমি বায়ুর সক্রিয় প্রভাবে ৬ থেকে ১৪ জুলাই চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক স্থানে ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হয়। এ সময় একদিনে সর্বোচ্চ দুইশ’ ৫৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়।