সাকিব আল হাসানকে সম্মান দিয়ে চট্টগ্রামবাসীই সম্মানিত হলো

81

বিশ্বকাপের নয় ম্যাচের মধ্যে আট ম্যাচে (শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল) ব্যাট হাতে নেমে সাত ম্যাচেই নিজের ইনিংসকে নিয়ে গেছেন পঞ্চাশোর্ধে। এর মধ্যে ছিল দুটি নান্দনিক শতক। টুর্নামেন্টে করেছেন তৃতীয় সর্বোচ্চ ৬০৬ রান। এক বিশ্বকাপে ৬০৬ রান, ১১ উইকেট। কোনো একটি বিশ্বকাপে কমপক্ষে ১০ উইকেট আর ন্যূনতম পাঁচশোর বেশি রান করতে পারেননি দুনিয়ার আর কোনো ক্রিকেটার। তাই চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) ক্রিকেট কমিটির উদ্যোগে ও সিটি কর্পোরেশনের সহযোগিতায় বিশ্বকাপে অনন্য ধারাবাহিক পারফর্ম করা সাকিব আল হাসানকে গতকাল বিকেলে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। উক্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। সংবর্ধনায় দেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে সাকিবের হাতে নগর চাবি তুলে দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
সংবর্ধনা হওয়ার কথা ছিল বিকেল চারটায়। কিন্তু বিকেল তিনটার আগেই পুরো স্টেডিয়াম এলাকা ঘিরে লোকে লোকারণ্য। লালখানবাজার থেকে শুরু করে কাজীরদেউড়ি পর্যন্ত সড়কের দুপাশে সাকিবের সংবর্ধনাকে ঘিরে বিলবোর্ড আর বিলবোর্ড। স্টেডিয়ামের গেইট দিয়ে ঢুকতেই হাজারো খুদে ক্রিকেটারদের মিলনমেলা। পুলিশের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার বেস্টনি পাড়ি দিয়ে একে একে ঢুকে পড়েন স্টেডিয়ামে। নানান রঙের ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড নিয়ে ‘সাকিব, সাকিব’ বলে গগণবিদারী চিৎকার। সবাই সাকিবের অপেক্ষায়। ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে হাজারো ভক্তের ভিড় ঠেলে সাকিবকে নিয়ে সংবর্ধনা মঞ্চে আসেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও সংবর্ধনা কমিটির আহবায়ক আলী আব্বাসসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা। তার আগে সাকিব আল হাসানকে প্যাভিলিয়ন গেইটে ফুলের বুকেট দিয়ে বরণ করেন সিজেকেএস যুগ্ম-সম্পাদক আমিনুল ইসলাম।
মঞ্চে সাকিবকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন সিজেকেএস ক্রিকেট কমিটির যুগ্ম সম্পাদক জিএম হাসান। মেয়রের হাতে ফুলের তোড়া তুলে দেন ক্রিকেট কমিটির আরেক যুগ্ম সম্পাদক শওকত হোসাইন। ক্রিকেট কমিটির সম্পাদক আব্দুল হান্নান আকবরের স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাকিবের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
এরপর শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বিসিবির সাবেক পরিচালক, বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজুদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর, সংবর্ধনা কমিটির আহবায়ক ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সহসভাপতি আলী আব্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সিজেকেএস সহসভাপতি মো. আবু হাসান সিদ্দিক। বক্তব্য শেষে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে সাকিবের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী ফরিদের নেতৃত্বে সালাউদ্দিন মো. রেজা, মঞ্জুর কাদের মঞ্জু ও নজরুল ইসলাম। সিজেকেএস ক্রিকেট কমিটির পক্ষ থেকে সাকিবের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন মো. আবু হাসান সিদ্দিক, আলহাজ্ব দিদারুল আলম চৌধুরী ও আবদুল হানান আকবর।
বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক সিরাজুদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, যে দেশে গুণীর কদর হয় না, সেখানে গুণী জন্মায় না। সাকিবকে সম্মাননা দিয়ে চট্টগ্রামের উদীয়মান ক্রিকেটারদের অনুপ্রাণিত করার সুযোগ দেয়ায় আয়োজকরা সাধুবাদ পাৗয়ার মত কাজ করেছেন।
সংবর্ধনা কমিটির আহŸায়ক ও সিজেকেএস ক্রিকেট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আলী আব্বাস বলেন, ক্রীড়াবান্ধব মেয়র হিসেবে পরিচিত পাওয়া চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সার্বিক সহায়তার কারণেই সাকিবকে সম্মানিত করার মতো অসাধারণ একটি আয়োজন আমরা করতে পেরেছি। এ জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। তাঁকে মেয়র হিসেবে আবারও রেখে দেয়ার আহবান জানান তিনি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন বিশ্বকাপের টানা ব্যস্ততা শেষে পরিবারকে নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণের পর মাত্র একদিন আগেই দেশে আসেন সাকিব। কয়েকদিন পর মাকে নিয়ে যাবেন হজ করতে। এতো ব্যস্ততার পরও সাকিব চট্টগ্রামের ডাকে সাড়া দেওয়ায় পুরো চট্টগ্রামবাসী সাকিবের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি আরো বলেন, ‘চট্টগ্রামের মানুষের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা আছে। চট্টগ্রামকে তিনি নিজের এলাকাই মনে করেন। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই চট্টগ্রামবাসীর পক্ষে বিশ্ব বরেণ্য এ ক্রিকেটারকে ‘নগর চাবি’ দেয়া হচ্ছে। তাকে সম্মানিত করে চট্টগ্রামবাসীই সম্মানিত হলো।’
আয়োজক কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাকিব বলেন, ‘আজকে আমার হাতে নগর চাবি তুলে দিয়ে আমাকে সম্মানিত করায় সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ও আলী আব্বাসকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা করবো অন্যান্য বিভাগও এভাবে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের সংবর্ধিত করবে। তাতে খেলোয়াড়দের দায়বদ্ধতা আরও বাড়বে। আমি চাই, ভবিষ্যতে চট্টগ্রামেরই কোন ক্রিকেটারের হাতে এই নগর চাবি উঠুক।’
সাকিব এরপর প্রায় আধাঘণ্টা ধরে খুদে ক্রিকেটারদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি উঠতি খেলোয়াড়দের বিভিন্ন উপদেশ-পরামর্শ দিতে গিয়ে বলেন, ‘সবার আগে নিজের পড়ালেখা ঠিক রাখতে হবে, মা-বাবার কথা শুনতে হবে, নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে এবং অনেক বেশি শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সাফল্যর জন্য কঠোর পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। কোন স্বপ্ন দেখলে সেই স্বপ্ন পূরণে লেগে থাকতে হবে, শুধু স্বপ্ন দেখতে থাকলেই চলবে না।’
সিজেকেএস ক্রিকেট কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক হাসান মুরাদ বিপ্লবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন সিজেকেএস সহ-সভাপতি মোজাম্মেল হক, মো. হাফিজুর রহমান, যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা আলম, কোষাধ্যক্ষ শাহাবুদ্দীন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ ইউসুফ, মো. মশিউর রহমান চৌধুরী, আছলাম মোরশেদ, ইঞ্জিনিয়ার জসীম উদ্দিন, রেখা আলম চৌধুরী, রেজিয়া বেগম ছবি, সিজেকেএস’র সর্বজেষ্ঠ্য কাউন্সিলর ডেরিক র‌্যান্ডলফ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়রবৃন্দ ও কাউন্সিলরবৃন্দ, সিজেকেএস এর কাউন্সিলরবৃন্দ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ সর্বস্তরের ক্রীড়াসংগঠক, চট্টগ্রামের ক্রিকেট একাডেমির প্রশিক্ষণার্থীবৃন্দ, ক্রীড়ামোদীবৃন্দ প্রমূখ।
চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস আর কালো ভুনা আমার খুবই প্রিয় : সাকিব
ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল ৫টার ঘরে। ধীর পায়ে পাঞ্জাবি গায়ে এমএ আজিজ স্টেডিয়ামে প্রবেশ করলেন ক্রিকেটের রাজপুত্র। চোখের সামনে স্বপ্নের নায়ককে দেখে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন গ্যালারি ভর্তি দর্শক। হাজার কন্ঠে ‘সাকিব, সাকিব’ শব্দে মুখরিত হলো পুরো স্টেডিয়াম পাড়া। অনেক আনুষ্ঠানিকতা। স্টেডিয়ামে উপস্থিত হাজারো ভক্ত তখনও অপেক্ষায় সাকিবের বক্তব্য শুনতে। মৃদুভাষী সাকিব আল হাসান সালাম দিয়ে বক্তব্য শুরু করলেন।
‘চট্টগ্রাম আমার খুব প্রিয় শহর। সেই ন্যাশনাল লিগ খেলতে আসতাম তখন থেকে খুব এনজয় করতাম চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস আর কালো ভুনা আমার খুবই প্রিয়। আমি চট্টগ্রামবাসীর প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে সম্মানিত করেছেন। এই চট্টগ্রামের মাটিতেই আমার টেস্ট অভিষেক হয়েছিল। তাই সময় সুযোগ পেলেই চট্টগ্রাম আসি। আমার জন্য দোয়া করবেন আমি যেন বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারি।’
মেয়র আরও বলেন, ‘কোটি ক্রিকেট ভক্তের মতো খুদে ক্রিকেটারদের কাছেও সাকিব স্বপ্নপুরুষ। তাকে কাছে পেলে খুদে ক্রিকেটাররা অনুপ্রাণিত হবে। এ জন্য এ অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে চট্টগ্রামের খুদে ক্রিকেটারদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যাতে চট্টগ্রাম থেকে সাকিব, তামিম বা মাশরাফির মতো মানের ক্রিকেটার উঠে আসে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবু হাসান সিদ্দিক বলেন, সাকিবের কারণেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ পরিচিত। সাকিব আমাদের কাছে শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনিই আমাদের বাংলাদেশ। তার মতো ব্যক্তিকে সম্মানিত করতে পেরে আমরা সম্মানিত হলাম। তাকে কাছে পেয়ে এখানকার তরুণরাও অনুপ্রাণিত হবে।
আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সাকিব শুধু একটি নাম নয়, নিজ গুণে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। সাকিবের অসাধারণ পারফরমেন্স এর কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বকাপের মঞ্চে ভালো খেলেছে। তার প্রতি সারাদেশের মানুষের সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীও কৃতজ্ঞ।
মেয়র বলেন, কোটি ক্রিকেট ভক্তের মতো খুদে ক্রিকেটারদের কাছেও সাকিব স্বপ্নপুরুষ। তাকে কাছে পেলে খুদে ক্রিকেটাররা অনুপ্রাণিত হবে। এ জন্য এ অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে চট্টগ্রামের খুদে ক্রিকেটারদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। যাতে চট্টগ্রাম থেকে সাকিব, তামিম বা মাশরাফির মতো মানের ক্রিকেটার উঠে আসে।