সাইবার বুলিং এবং আমাদের দুশ্চিন্তা

103

রাফিউল ওমর খান

বর্তমান বিশ্ব করেনার ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। লকডাউন চলাকালীন সকলেই ঘরে থাকার চেষ্টা করছে। নিজের এবং নিজের পরিবারের সুরক্ষার জন্য অপ্রয়োজনে কেউ তেমন একটা বাহিরে বের হচ্ছেন না। ঘরে বসেই ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমেই সকলে নিজেদের প্রয়োজনীয় কাজ সারছেন। ঘরেবসে অফিস, ব্যবসা বাণিজ্য, কেনাকাটাসহ সকল কিছুর জন্যই ইন্টারনেট এখন সবচেয়ে উপকারি এবং সহজ অপশনে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারছে।
অনেক উপকারের পাশাপাশি ইন্টারনেটের ব্যবহার এখন অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটনার জন্যও দায়ী হয়ে যাচ্ছে। সাইবার অপরাধ থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটির মানুষ সম্মুখীন হচ্ছেন তা হলো সাইবার বুলিং। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যেমন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে সাইবার বুলিজমও।
সাধারণত একজন ব্যক্তি যখন অন্য ব্যক্তির মাধ্যমে অনলাইন জগতে কোন প্রকার ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য ছড়িয়ে দেয়া, যেকোন প্রকার হুমকি প্রদানের মাধ্যমে, ভিডিও বা অডিও এর মাধ্যমে, গুজব রটানোর মাধ্যমে বা মিথ্যা তথ্য প্রদানের মাধ্যমে ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখনই তাকে আমরা সাইবার বুলিং বলে থাকি।
নারী পুরুষ সকলেই এই ধরনের বুলিংয়ের শিকার হতে পারেন। তবে এতে নারীদের সংখ্যাটাই অনেক বেশী। নারীদের উত্যক্ত করার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বার্তাসহ ব্যক্তিগত ভাবে নানান উপায়ে বুলিং করা হচ্ছে। এতে অনেকেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন, মানসিক চাপে ভোগছেন। ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় ভোগে অনেকেই নিজের পছন্দের কাজগুলো থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে শারীরিক এবং মানসিক দুভাবেই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। যার ফলে আত্মহত্যামূলক প্রবণতাও মাঝেমাঝে দেখা যায়।
প্রযুক্তি বিষয়ক সেবা প্রদানকারি ওয়েবসাইট ঈড়সঢ়ধৎরঃবপয.পড়স এর যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক একটি গবেষণায় দেখা যায় প্রায় ৫৯ শতাংশ স্কুল/কলেজে পড়ুয়া ছেলে-মেয়েই কোন না কোন ভাবে অনলাইন বুলিং এর শিকার হয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র ৩৩ শতাংশ ভুক্তভোগী এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়েছেন। মাত্র ৩৪.৯ শতাংশ অভিভাবক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতন। এছাড়াও এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মোবাইল বা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কমিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে নিজেদের সন্তানদের দূরে রাখছেন। তারা এটিকেই একমাত্র সমাধান বলে মনে করছেন।
বর্তমানে অনেক বেশী মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়ায় এবং সোশাল মিডিয়াগুলো সহজ প্রাপ্য হওয়ায় এই ধরণের অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ধরণের কাজের সাথে স্কুল-কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরাই বেশী জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ কোয়ারেন্টাইনে সময় কাটানোর জন্য মজা করার দোহাই দিয়ে এই ধরণের কাজে লিপ্ত হচ্ছে, আবার কেউ কেউ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এই ধরনের কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। তাই লকডাউন চলাকালীন সময়ে এটিও মারাত্মকভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ দেখা দিয়েছে। জনপ্রিয় ব্যক্তিদের অনলাইন বুলিংয়ের শিকার হওয়ার ঘটনা এখন আর নতুন নয়। আমরা যখন সকলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত, কিভাবে মানসিক ভাবে সুস্থ থাকা যায় তা নিয়ে ভাবছি, তখন এই বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ই-বিজনেসের মাধ্যমে অনেক নারীই বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন-হচ্ছেন। নিজেরা উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি আরও অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। এতে করে বেকারত্বের হার কিছুটা হলেও কমছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাদের ব্যবসায়িক পোস্ট গুলোতে কিছু মানুষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে খারাপ ভাবে মন্তব্য করছেন। এতে করে অনেকেই ই-বিজনেসের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। যা আমাদের অর্থনীতির জন্যও বিরাট একটি হুমকি। অনেকেই এসব ব্যাপারে সচেতন হলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষ এসব ব্যাপারে উদাসীন।
সাইবার বুলিং সহ যাবতীয় হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে। নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্য সোশাল মিডিয়াগুলোতে দেয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। সাইবার বুলিং এর শিকার হচ্ছেন বলে মনে হলে প্রমাণাদিগুলো সংগ্রহ করতে হবে, যাতে পরবর্তীতে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। নিজের মা-বাবা, পরিবারের সদস্য কিংবা খুবই কাছের কারও সাথে ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজনীয়। এতে করে নিজের সাহস বাড়ে এবং পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সহজ হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করেও সাইবার বুলিং বন্ধ না হলে, আইনের সহায়তা নিতে হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই বিষয়ক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট সেবা গ্রহণের পাশাপাশি সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারটিও আমাদের সকলকে চিন্তায় রাখতে হবে। ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না করে কেউ যাতে অনলাইনে হয়রানি কিংবা বুলিং এর মতো ঘটনার সাথে জড়িয়ে না পড়ে সে ব্যাপারে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে। অভিভাবকদেরও সচেষ্ট থাকতে হবে যাতে করে তার সন্তান বুলিং এর সাথে জড়িয়ে না পড়ে। সচেতনতা, নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং আইনি প্রয়োগ কঠোর করার মাধ্যমে ইন্টারনেট জগৎ কীভাবে তার ব্যবহারকারীদের জন্য বিশেষ করে নারীদের জন্য নিরাপদ করা যায় সে ব্যাপারে বিস্তারিত পদক্ষেপ নেওয়ার এখনই সময়। পারিবারিক এবং সামাজিক পর্যায়ে এই ধরণের অপরাধের বিরুদ্ধে সচেষ্ট থাকতে হবে। নয়তো এখনও যেমন অনেকেই রাস্তায় চলাচলে ভয় পান, অভিভাবকরা দুশ্চিন্তায় থাকেন, ঠিক তেমনি সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে এক সময় ইন্টারনেট ব্যবহারেও ভীতির সৃষ্টি হবে। অচিরেই সোশাল মিডিয়াগুলো নারী উত্ত্যক্ত করার স্থানে পরিণত হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়