সাংবাদিক বললেন, এগুলি শিক্ষার দোকান

86

এক.
আমি পত্রিকায় কলাম লিখি, সে কারণে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্র জগতের মানুষের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে। চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী সাংবাদিক নেতা আমাকে বল্লেন, জামাল খান রোডে অবস্থিত একটি ব্যক্তি মালিকানার স্কুলের অধ্যক্ষকে তিনি ফোন করে, উনার এক আত্মীয়ের ছেলেকে টিসি দিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ করে দিতে বলেছিলেন। সাংবাদিক নেতা মোবাইল ফোনে আমাকে বল্লেন, অধ্যক্ষ তার অনুরোধ রাখেননি, টিসি দেননি, বরং কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সাংবাদিককে হুমকি ধমকি দেন, এমন সব অশ্রাব্য গালি সাংবাদিককে দিয়েছেন বলে সাংবাদিক আমাকে জানান, যা এখানে লিখা সম্ভব নয়। আমি সাংবাদিককে বল্লাম, কুকুর মানুষকে কামড়ায়, মানুষ কুকুরকে কামড়ায়না। আপনি ধৈর্য্য ধরেন।
চট্টগ্রাম শহরে অলিতে গলিতে ব্যক্তি মালিকানার স্কুল আছে। শহরের ব্যস্ত এলাকায় চায়ের দোকান, পানের দোকান, ফলের দোকানের ভিড়ে ঘর ভাড়া নিয়ে স্কুল খুলেছে কিছু উদ্যোক্তা। স্কুলের বাহারী নাম। ব্যবসা মানসিকতার উদ্যোক্তারা কোন এক সময় হয়ত কোচিং সেন্টার চালাত। তাদের আছে ছাত্রছাত্রী আকৃষ্ট করা এবং অভিভাবককে তাক্ লাগিয়ে দেয়ার মতো বিজ্ঞাপনী কৌশল বা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অফিসগুলির সাথে তারা সুসম্পর্ক রাখে। শিক্ষার্থী আকর্ষণের জন্য তারা নিতে জানে বৈচিত্র্যপূর্ণ কৌশল। মার্কেট ইকনমির যুগে কেউ যদি স্কুল খোলে তাকে নিষেধ করা যাবেনা। কিন্তু প্রশ্ন উঠে তারা সরকারের অনুমতি নিয়েছে কিনা, এবং স্কুল খোলার জন্য সরকারের শর্ত মানছে কিনা। নাকি, শর্ত ভংগ করে এক স্কুলের ৫/১০ টি শাখা পরিচালনা করছে। এরা কি অন্য স্কুলের নামে ভর্তি দেখায়, অন্য স্কুলের নামে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নেয়? সাংবাদিক নেতা আমাকে বল্লেন, স্যার, এ গুলিকে স্কুল বলবেন না, এগুলি শিক্ষার দোকান। এরা শিক্ষা বিক্রি করে। কিন্তু শিক্ষা পণ্য নয়। সাংবাদিক বল্লেন, “দোকান” গুলি চায়ের দোকান, পানের দোকানের পাশে ভাড়ার ঘরে চালানো হয়। শিক্ষা এখানে পণ্য। সুশিক্ষার পরিবর্তে মুনাফা লোভীরা যে অপরিপক্ক “শিক্ষা- পণ্য” বিক্রি করে তা সমাজকে কিভাবে পর্যদুস্ত করে- তা কি স্যার ভেবে দেখেছেন? আমার কাছে সাংবাদিক নেতার এটা ছিল প্রশ্ন। কোচিং সেন্টার, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে পরিচালিত স্কুলগুলি আসলেই শিক্ষার মান কমাচ্ছে। আক্ষেপ সাংবাদিকের।
দুই.
শিক্ষা প্রদানের (ডিসিমিনেশন) পদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধরন এবং শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে লেখার ব্যাপারে বা কথা বলার সময় আমি সতর্কতা অবলম্বন করি। শিক্ষার গুণগত মান কেমন হওয়া উচিৎ- সেটা জটিল এবং সেনসিটিভ বিষয়। এখানে আমার মনগড়া কথা বলার সুযোগ নাই। তবে এটা বলতে পারি শিক্ষা পণ্য নয়। এখানে বাণিজ্য অচল। শিক্ষাকে কেউ পণ্য বানিয়ে দোকানদারী করলে- তাকে প্রতিহত করা উচিৎ। শিক্ষা দোকানের শো কেসে বিক্রয় যোগ্য প্রডাক্ট হিসেবে রাখা হবে এটা কখনো হতে পারেনা। সাংবাদিক নেতা কথা শেষ করার সময় আমাকে বল্লেন, স্যার, আমি ছাত্র নিয়ে আসার জন্য ওই স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে ফোন করে টিসি চেয়েছিলাম। উনি আমাকে গালি দিয়েছেন (অশ্রাব্য), আপনি আমার নাম উল্লেখ করে লিখতে পারেন। আমি সাংবাদিক নেতাকে শান্ত থাকতে বল্লাম, কুকুর মানুষকে কামড়ায়, মানুষ কুকুরকে কামড়ায়না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে উন্নততর চিন্তার স্থান। এটা রাগারাগি বা রেষারেষির জায়গা নয়। এখানে ক্ষুদ্রতা কেন? কিন্তু সাংবাদিককে ওই অধ্যক্ষ গালি দিতে পারেন? পারেন না।
তিন.
ক্লাশে পাঠদানের পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিৎ? এই প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার মান উন্নয়নে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ছয়/সাত মাসের মধ্যে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড কয়েকটি উঁচু পর্যায়ের মোটিভেশন সভা করেছে। তাতে শিক্ষা বোর্ড অঞ্চলের সকল প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ডাকা হয়েছে। কলেজ ও স্কুলের জন্য আলাদা আলাদা আলোচনা সভা হয়েছে। সেখানে প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ উনাদের সমস্যার কথা বলেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (এডিশনাল সেক্রেটারী) অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা দিনব্যাপী আলোচনায় দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। পরীক্ষা সংক্রান্ত কাজে প্রশিক্ষিত করার জন্য চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড নিয়মিত পরীক্ষকদের নিয়ে সভা করেন। মাউশি চট্টগ্রাম অঞ্চল এখন নিয়মিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। সুতরাং শিক্ষার মান বৃদ্ধি ও ক্লাসে পাঠদানের মান উন্নয়নের জন্য সরকার যে তৎপর একথা না বললে- আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকবে। কিন্তু এই ধারার বাইরে থেকে যাচ্ছে অনিবন্ধিত ও অনুমতিবিহীন স্কুল গুলি। তাদের উদ্যোক্তা/অধ্যক্ষদের দিকে ভাল করে তাকালে দেখবেন, তারা নামের আগে “ডক্টর” লিখছেন, তারা “প্রফেসর” লিখছেন, পিএইচডি করলে- তার সঠিক রেকর্ডপত্র থাকতে হবে। এগুলি দেখা উচিৎ। নিজের কৃতিত্ব জাহির করে ছাত্রছাত্রীদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। আমাদের শিক্ষকগণ আমাদের কাছে ছিলেন অনুকরনীয় ব্যক্তিত্ব।
চার.
রাস্তায় অলিগলিতে গজিয়ে উঠা স্কুলগুলিকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা উচিৎ। পাবলিক পরীক্ষার ফরম ফিল আপের সময় প্রত্যেক স্কুল প্রধানকে শিক্ষাবোর্র্ডের কাছে অঙ্গীকারনামা দিতে হয়, যে উনি অন্য স্কুলের পরীক্ষার্থীর নাম রেজিস্ট্রেশন করাচ্ছেন না। অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা নিজের নামের আগে অধ্যক্ষ লিখে, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখা দরকার।
আমরা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিশ্বমানের পর্যায়ে দেখতে চাই। আমাদের সেরকম হিউম্যান রিসোর্স আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি অনেক। গত সপ্তাহে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ওই পত্রিকার সংবাদদাতা ওয়াসিম চট্টগ্রাম নগরে কোচিং এর দৌরাত্ম্য বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রিপোর্টটি পড়ে গা শিউরে উঠেছে। কোচিং এর নামে এসব কি হচ্ছে? শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে বেচা বিক্রি যারা করে, যারা শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্য করে। তাদের হাতে আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে তুলে দিতে পারিনা। কোচিং সেন্টারের ব্যাপারে সরকার কঠোর মনোভাবে আছে। মুনাফালোভী, কমিশনভোগীরা করিৎকর্মা ব্যবসায়ীদেরকে ঠেকাবে? যেখানে মধু সেখানে মৌমাছি, যেখানে লাভ সেখানে ব্যবসায়ী। শিক্ষাকে “ব্যবসায়ীদের” হাত থেকে বাঁচাতে হবে। শিক্ষার দোকানগুলিকে চিহ্নিত করতে হবে। শিক্ষার দোকানদারদের থামাতে হবে।
পাঁচ.
শিক্ষাতে জাতির যে বিনিয়োগ তা নিরর্থক নয়। শিল্প উন্নত দেশগুলির এক্সপার্টরা আমাদের বলেন, তোমাদের দেশ দ্রæত গতিতে উন্নত হচ্ছে। তোমাদের শিল্প কারখানা, বিজনেস হাউস, হাসপাতাল, বিনোদন কেন্দ্র, সম্পদ আহরনের স্থাপনাগুলিতে তোমাদের অনেক প্রশিক্ষিত ম্যান পাওয়ার, হিউম্যান রিসোর্স দরকার হবে। সোনা, হীরা, এপার্টমেন্ট, গাড়ি, প্লেনের চাইতে বড় সম্পদ হলো মানব সম্পদ। শিক্ষার বিনিয়োগ হলো সামাজিক বিনিয়োগ। আগামী ৫/১০ বছর পর তোমাদের যে এক্সপার্ট, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, পাইলট, চালক, উদ্ভাবক, প্রযুক্তিবিদ লাগবে, এই মহা “মানব শক্তি” কোথায় তৈরি হয় জান? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মানব সম্পদ তৈরির কারখানা। কেন তোমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা বুঝতে পারছনা? আমরা গ্রস ন্যাশনাল বা ডোমেস্টিক প্রডাক্টের পেছনে ছুটি। গ্রস ন্যাশনাল পিস এন্ড হ্যাপিনেসের পেছনে ছুটিনা। আমাদের আগামী ২০ বছরে দেশের কি রকম ম্যান পাওয়ারের চাহিদা হবে তার একটা পারসপেক্টিভ সার্ভে আমরা করতে পারি। সে অনুসারে স্কুল কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কারিকুলাম বানাতে পারি। শিক্ষার একটি সুনির্দিষ্ট টার্গেট থাকা দরকার। কেমিস্ট্রিতে অনার্স মাস্টার্স করে আপনি ব্যাংকের অফিসার হলেন। এটা কেমন হলো? শিক্ষার দোকান দিয়ে আগামীর চাহিদা মেটানো যাবেনা। শিক্ষার দোকান না পারবে জ্ঞানগর্ভ সৃজনশীল শিক্ষা নিশ্চিত করতে, না পারবে চাহিদা ভিত্তিক (ঘববফ ইধংবফ)শিক্ষার ভিত্তি তৈরি করতে। জ্ঞান- কোন পণ্য নয়।
ব্যক্তি মালিকানার অনুমোদনহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন তদারকি নাই। বলা হচ্ছে, শিক্ষকরা ক্লাসে যান এবং লেকচার নামক একটি ফিনিশ্ড প্রডাক্ট ছাত্রছাত্রীদের উপহার দেন। এটা বন্ধ করে ক্লাস রুম পারফরমেন্সকে পার্টিসিপেটরি বা অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। দোকানের পাশে, মার্কেটের নিচে অপরিসর কক্ষে কোমলমতি বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়ার আইডিয়া বাস্তব সম্মত নয়। বাচ্চারা বয়সে ছোট হলেও তাদের কল্পনার জগৎ বিস্তৃত। একজন শিক্ষাবিদ উনার অভিজ্ঞতার কথা আমাকে বলেছিলেন। এক শিশুকে ছবি আঁকতে দেয়া হয়েছিল। বাচ্চা- একটি চেয়ার আঁকল। চেয়ারে বসা পাঞ্জাবি গায়ে, টুপি মাথায় এক মধ্য বয়সী লোকের ছবি আঁকল। মধ্য বয়সী লোকটির হাতে একটি বেত। পাজামা পাঞ্জাবি টুপী মাথায় বেত হাতে চেয়ারে বসা লোকটি আসলে ওই বাচ্চার শিক্ষক। সে তার শিক্ষককে যে ভাবে কল্পনা করেছে, সেভাবে সে এঁকেছে। শিক্ষাবিদ আমাকে বল্লেন, আমি ছবিটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। এক যায়গায় ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলাম। ব্যতিক্রম কি? মধ্য বয়সী সে শিক্ষক চেয়ারে বসে আছেন কিন্তু উনার পা মাটি থেকে আলগা। শিশুর কল্পনায় এটা এসেছে যে, সে নিজে চেয়ারে বসলে তার পা যেভাবে মাটি থেকে আলগা থাকত, তার শিক্ষকের পা ও সে আলগা রেখেছে। শিশুর এই সৃজনশীলতা থেকে কি বোঝা যায়? শিশু অবুঝ?
শিক্ষা এখন দোকানে। সে দোকানে শিশুর সৃজনশীলতা শিক্ষা ব্যবসায়ীদের চাপে পিষ্ট হচ্ছে। সাংবাদিক নেতাকে বল্লাম, আমাদের শিক্ষা এখন জামালখানের দোকানে- এটা কখনো হতে পারেনা। সরকার আশা করি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। অনুমতিবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে আশা করি।
লেখক : সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ,
অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
ঊ-সধরষ: ভধুষঁষযড়য়ঁবথ৭@ুধযড়ড়.পড়স