সাংবাদিক ডি পি বড়ুয়া বৌদ্ধসমাজ ও জাতীর এক কীর্তিমানের বিদায়

179

ড. জিনবোধি ভিক্ষু

স্বাধীন বাংলাদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সুলেখক, ‘এশিয়ান বৌদ্ধ শান্তি সংস্থা বাংলাদেশে’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের মহাসচিব বিশিষ্ট সাংবাদিক মি. দেবপ্রিয় বড়ুয়া (ডি.পি. বড়ুয়া) আজ ভোর পৌনে ছ’টায় ঢাকাস্থ নিজ বাসভবনে বার্ধক্যজনিত কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল প্রায় একানব্বই বছর। তিন সন্তানের জনক তিনি। তাঁর সহধর্মিণী সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষিকা করুনা বড়ুয়া আগেই দেহত্যাগ করেছেন।
তাঁর মৃত্যুতে সাংবাদিক মহল এবং বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজে শোকের ছায়া নেমে আসে। মি. ডি. পি. বড়ুয়া বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের একজন আলোকিত ব্যক্তি নয় শুধু তিনি অসাম্প্রদায়িক এবং দেশের বুদ্ধিজীবী মহলে প্রথম সারির একজন ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও বহু বিদ্ব্যজনের কাছে পরিচিত একটি মুখ। তিনি একজন বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অসাধারণ প্রতিভা গুণে সাংবাদিকতা জগতে প্রথম সারির সাংবাদিক হিসেবেও দেশ-বিদেশে যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালের আগে থেকে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সৈনিক। ১৯৫৩-৫৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত (ঢাকসু) সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালি বৌদ্ধদের ইতিহাসে স্বাধীনতার পূর্বে তিনিই প্রথম। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের যোগ্যতম মহাসচিব হিসেবে তিনি দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করেন। এ সংগঠনকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিলো অসামান্য।
এ সংস্থার সভাপতি মহাসংঘনায়ক প্রয়াত শ্রীমৎ বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরোর সঙ্গে মহাসচিব থাকাকালীন তিনি এ দেশের বৌদ্ধদের কল্যণে প্রভ‚ত অবদান রেখেছিলেন। ঢাকাস্থ বাংলাদেশ বুদ্ভিস্ট ফেডারেশন ও ঢাকা আন্তজার্তিক বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর অনন্য ভূমিকার কথা সর্বজন বিদিত। এশিয়ান বৌদ্ধ শাস্তি সংস্থা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সহ বহু আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের বরেণ্য সাংঘিক ব্যক্তিত্ব, মহামান্য সংঘরাজ সাহিত্যিক প্রয়াত শীলালংকার মহাস্থবির, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক পন্ডিত প্রয়াত শান্তপদ মহাথের, মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক সংগঠক একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকে ভূষিত দশম সংঘরাজ পন্ডিত প্রয়াত জ্যোতিপাল মহাথের, উপ-সংঘরাজ পন্ডিত প্রয়াত সুগতবংশ মহাস্থবির, প্রফেসর ড. জিনবোধি ভিক্ষুসহ বহু পূজনীয় ভিক্ষুসংঘকে আন্তর্জাতিকভাবে সন্মান দানের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন।
ঢাকাস্থ কমলাপুর ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহারে ভূমি ব্যবস্থায় ও বিহার উন্নয়নের ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রণী। বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘের ট্রাস্টিদের মধ্যে অন্যতম একজন সদস্যও মি. বড়–য়া। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ মানসিক প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি এবং পরবর্তীতে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করে মূল্যবান প্রবন্ধ উপস্থাপন করে দেশের সুনাম বয়ে এনেছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হিসেবে ১৯৭৪ সালে মিশর ও কুয়েত সফর করেন। সেই সময়ে কুয়েতের আমীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছিলেন। যা দেশের জন্য অমূল্য দলিল হয়ে আছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ মে বাসসের প্রতিনিধি হয়ে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হিসেবে ভারতের দিল্লিতে যান। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ৭০ মিনিটের একটি সাক্ষাতকার গ্রহণ করার সৌভাগ্য লাভ করেন তিনি। এছাড়াও তিনি ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের নব জাগরণের পথিকৃৎ অনাগারিক ধর্মপালের জন্মশত বার্ষিকী অনুষ্ঠানে যোগদান করে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি বন্দরনায়েকে রাজাতুঙ্গার সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে মঙ্গোলিয়া সফরের সময় মঙ্গোলিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্টের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে বাসসের মাধ্যমে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। যা যথেষ্ট সুনাম বয়ে আনে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে সাংবাদিক জগতে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। তাঁর গবেষণাধর্মী কয়েকটি গ্রন্থ ও মূল্যবান প্রবন্ধ (ইংরেজি-বাংলা)সুধী মহলে প্রশংসিত। তিনি কয়েকটি সাময়িক ম্যাগাজিনের সম্পাদক, জাতীয় পত্রিকা ও চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীতে উপসম্পাদকীয় কলামে রীতিমতো লিখতেন।
এ জ্ঞান তাপস মিঃ ডি.পি. বড়ুয়া চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী মহামুনি পাহাড়তলী গ্রামে ১৯৩০ সালের ১০ এপ্রিল এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ডা. তেজেন্দ্র লাল বড়ুয়া ও মাতা রতœগর্ভা সন্তোষিনী বড়ুয়া। তাঁরা এক ভাই তিন বোন। দেবপ্রিয় বড়ুয়া পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ১৯৪৬ সালে মহামুনি এ্যাংলো পালি হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৫ সালে ইংরেজি বিষয়ে বিএ অনার্স এবং ১৯৫৮ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ব্যাংকের চাকুরির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবন শুরু। ১৯৭৪ সালে সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’য়। ১৯৯০-৯৬ সাল পর্যন্ত এর প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য সাংবাদিক জীবনে ৫০ এর অধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও বিদেশ সফর করেন।
ঢাকা আন্তর্জাতিক মেরুল বাড্ডা বৌদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা ছিল। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যসহ বহু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালে এবিসিপি স্বর্ণপদক, বিশ্বশান্তি দূত, অতীশ দীপঙ্কর শান্তি পদক, বেণী মাধব পদক সহ বহু দেশ-বিদেশ থেকে সম্মাননা লাভ করেন। এ জ্ঞান তাপস ডি.পি. বড়ুয়ার মৃত্যুতে শুধু একটি বিশাল নক্ষত্রের পতন নয়, বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজের অপূরণীয় ক্ষতিও বটে। দেশ হারিয়েছে একজন বহুমুখী প্রতিভাদীপ্ত বরেণ্য সাংবাদিক। আমি হারিয়েছি একজন পরম কল্যাণমিত্র সুহৃদকে। তাঁর এই শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়। বর্তমান অবক্ষয়ের যুগে তাঁর মতো নিবেদিত প্রাণ, সমাজ সচেতন, সংস্কৃতিমনা, মুক্তচিন্তক ও প্রজ্ঞাদীপ্ত মানুষের খুবই প্রয়োজন। তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সাহসী এবং দেশপ্রেমিক। চারিত্রিক সততার এক বিরল আদর্শ তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেছেন। তিনি সংঘ সমাজের প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আচরণে মহৎ এবং সৌজন্যে বিনয়ী ও আন্তরিক। কর্মক্ষেত্রে সর্বজনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। যাঁর জীবন মহৎভাবে উদ্ভাসিত। বিদ্যা বুদ্ধি প্রতিভায় ছিলেন অতুলনীয়। বলতে পারি, মেধা ও প্রতিভা অর্জনে অসাধ্য সাধন করেছেন মি. দেবপ্রিয় বড়ুয়া। তেমনি নানাভাবে প্রতিভার স্বাক্ষর স্বরূপ বহু সম্মানিত হয়ে বঙ্গীয় বৌদ্ধ সমাজ ও জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন। ‘নিব্বানং পরমং সুখং’।
লেখক : প্রফেসর
পালি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়