‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’

339

সন্দেহ নেই সাংবাদিকতা হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর ও সম্মানজনক পেশাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর পেছনে কারণও আছে। কারণ এই— যারা সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত, তারা সবার সামনে তথ্য ও সত্যকে তুলে ধরেন। এই তুলে ধরার কাজটা সহজ নয়। কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। সাংবাদিকরা এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করেন প্রতিনিয়ত। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আছেনা— ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’। সত্যিকার সাংবাদিক যারা, তাদেরকেও ‘সত্য’ নামক ‘কঠিন’কে ভালোবেসে সামনের দিকে এগুতে হয়। দিন নেই, রাত নেই, সারাক্ষণ তাদেরকে লেগে থাকতে হয় সংবাদ সংগ্রহের পেছনে। কথাগুলো মনে পড়ে গেলো ‘সাংবাদিকতা রাত বিরাতে’ বইটি পড়ে। বইটি যিনি লিখেছেন, তিনি দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে অনেক সাংবাদিক আছেন, যাদের পঠিত বিষয় ও পেশার মধ্যে পার্থক্য মেরু দূর। ফলে পেশাদারিত্বের ক্ষেত্রে তারা পদে পদে নানান প্রবলেমের সম্মুখীন হন এবং কখনো কখনো পিছিয়ে পড়েন। বইটির লেখক মাহফুজুর রহমানের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ফলে তাঁর পঠিত বিষয় ও পেশা কখনো পরস্পরের প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেনি, বরং এমন এক প্রীতিময় পরম্পরা সৃষ্টি করেছে, যাকে এককথায় বলা যায় সোনায় সোহাগা। ‘লেখকের কথা’য় তিনি নিজেই লিখেছেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে এ পেশায় সম্পৃক্ত হওয়ার সূযোগ পেলাম। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এটি একটি বড় সুযোগ। কারণ এ দেশে ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়ের সাথে মিল রেখে ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে পারে না। আমার ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি এই যে, আমি এ দুটোর মধ্যে মিল রাখতে পেরেছি।”
একসময় ছিলো, তথ্য সংগ্রহের বা সরবরাহের এত তড়িৎ ও আধুনিক উপকরণ ছিলোনা। তখন এর গতি ছিলো গরু গাড়ির মতো মন্থর। ফলে যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে, সেই সংগ্রহকে সংবাদে রূপান্তরিত করতে এবং সেই সংবাদ পাঠক পর্যন্ত পৌঁছতে যে পর্যন্ত সময় নিতো, বর্তমান কালের বিচারে সেটা বাসি বলেই বিবেচিত হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, পত্রিকায় পড়েছি, সেই যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে এবং তা সংবাদ আকারে প্রকাশ করতে পৃথিবীর প্রথমসারির পত্রিকাগুলোর পর্যন্ত একসপ্তাহ সময় লেগে যেতো। সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা যেমন ছিলো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তেমনি ছিলো ঝুঁকির। বর্তমানে সাংবাদিকতার ক্ষেত্র যেমন সম্প্রসারিত হয়েছে, তেমনি এর সূযোগও স¤প্রসারিত হয়েছে। একসময় সাংবাদিকতাকে যেখানে চাকুরির চেয়ে সম্মানজনক পেশা হিসেবে গ্রহণ করতো, এখন সূযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্মানের সাথে সাথে চাকুরির পেশা হিসেবেও গ্রহণ করছে আধুনিক প্রজন্মের তরুণ তরুণীরা। ফলে এই পেশায় প্রতিযোগিতা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে চাহিদা। আগে যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ হাতে গোনা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছিলো, এখন সরকারি বেসরকারি মিলে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগটি খোলা হয়েছে। ফলে সংবাদ মাধ্যমগুলো বিষয়টি সম্পর্কে পড়াশোনা করা ও প্রশিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম পাচ্ছে পেশাটিতে।
সংবাদপত্র বা সংবাদ মিডিয়াকে গণমাধ্যমও বলা হয়। যেহেতু গণমাধ্যম, সেহেতু গণমুখীতা হচ্ছে এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বাংলাদেশে সংবাদপত্রে সত্যিকার গণমুখীতার সূচনা ১৯৪৮ সালের পর থেকে — ভাষার স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে। এই ভাষার স্বাধীনতা ভৌগোলিক স্বাধীনতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ভাষার স্বাধীনতা না থাকলে ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্থহীন ও অকার্যকর হয়ে পড়ে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাংলাদেশের সংবাদপত্র যে গণমুখী ভুমিকা পালন করে, তা যেমন গর্ব ও গৌরব করার মতো, তেমনি মাধ্যমটির জন্যও মাইলফলক। এই গণমুখীতা একেক করে আরো এগিয়ে যায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে, সত্তরের নির্বাচনে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও গণমাধ্যমগুলো তাদের গণমুখী ভ‚মিকা পালনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে।
সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এটাকে কেউ কেউ দায়বদ্ধতাও বলেন। এই দায়বদ্ধতার বিষয়টিকে দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বইটির লেখক মাহফুজর রহমান। তিনি লিখেছেন, “একটি সংবাদ প্রতিবেদনে একজন সাংবাদিক কখনোই নিজের কথা বলেন না। সাংবাদিকরা তাদের লেখায় আসলে অন্যের কথা যেভাবে বলা হয়েছে ঠিক সেভাবে তুলে ধরেন। কোনো ঘটনা যেভাবে ঘটেছে ঠিক সেভাবে তুলে ধরাই হচ্ছে তার দায়িত্ব।… সাংবাদিক কোন ঘটনার অংশ নন। তিনি উপস্থাপক মাত্র। খুব সৎ ভাবে কাজ করতে গেলেও তাতে বিচ্যুতি থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে ঘটনার সাথে নিজেকে কিংবা নিজের মতামতকে জড়িয়ে না ফেলাই উত্তম কাজ।” (পৃ.-৫৪)। এই যে বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা কিংবা দায়বদ্ধতা- এসব একটি অন্যটির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একটিকে বাদ দিলে অন্যটি পঙ্গু বা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। এগুলোর সঠিক কার্যকরীতা নির্ভর করে সাংবাদিকের অর্জিত বাস্তব ও বুদ্ধিদীপ্ত অভিজ্ঞতা এবং সততার ওপর, যে সততাকে সাংবাদিক-সততাও বলা যেতে পারে। একজন সাংবাদিক যখন তাঁর পেশার ক্ষেত্রে কোনো পক্ষাবলম্বন করেননা, মানে সৎ থাকেন, তখন তাঁর কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ আশা করা যায় এবং সেটা দেশ ও দশের জন্য মঙ্গলজনক। সেরকম সাংবাদিক তখন দেশ ও জাতির বিবেক হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষতাকে এস্টাবলিশমেন্ট ও স্বৈরাচারী সরকার সহ্য করতে পারেনা, শত্রæর চোখে দেখে। কথায়ও তো আছে- হক কথার ঢক নাই, গরম ভাতে বিলাই বেজার। যারা বেজার বা বিদ্বিষ্ট তারা সংবাদপত্রের কন্ঠ রোধ করার জন্য নানানরকম আইন তৈরি করে, বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়, অদৃশ্য বা অলিখিত আদেশের মাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচার না করতে বাধ্য করে। সরকারি প্রেস নোটের উপর নির্ভর করা ছাড়া কোনো উপায় থাকেনা। সেজন্যই বোধ হয় একজন কবি, যাঁর নাম এ মুহূর্তে মনে আসছেনা, ষাট কি সত্তর দশকে প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লেখা পদাবলিতে লিখেছিলেন- ‘তোমার প্রেম সরকারি প্রেস নোটের মতো মিথ্যে’।
স্বৈরাচার সবসময় সৎ সাংবাদিকতাকে সতীনের দৃষ্টিতে দেখে। সত্যকে তারা ভয় পায়- একারণে। কাতার ভিত্তিক নিউজ চ্যানেল আল-জাজিরা’র কথা ধরুন। যখন তারা সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলো, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং তাদের দোসর ও দালালদের দুচোখের দুশমন হয়ে দাঁড়ালো। আমেরিকার টুইনটাওয়ার ধ্বংসের পর বুশ যখন হুশ হারিয়ে মারণাস্ত্র থাকার মিথ্যে অজুহাতে ইরাকে আগ্রাসন চালালো, তখন আল-জাজিরা তাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো। কারণ বিবিসি ও তাদের সমমনা নিউজ চ্যানেলগুলো যখন নিমক হালাল করার জন্য একধরনের নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা করে যাচ্ছিলো, তখন আল-জাজিরা সরেজমিন প্রতিবেদনের মাধ্যমে সেখানকার সত্য তথ্যকে তুলে ধরছিলো সাহসের সাথে। সেকারণে বুশ এত ক্ষেপে গিয়েছিলেন যে, চ্যানেলটিকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শুধু বুশ কেন, তাঁর বন্ধু বা বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলোও সেই বিদ্বেষী মনোভাব বজায় রাখে চ্যানেলটির বিরুদ্ধে। প্রমাণ হিসেবে কয়েকটি পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম পেশ করছি। দৈনিক প্রথম আলোর (২৮ জুলাই ২০১৭) শিরোনাম – ‘আল-জাজিরার সম্প্রচার বন্ধ চান নেতানিয়াহু’। একই পত্রিকায় ১০ আগস্ট ২০১৭ সালে মার্ক লে ভাইন’র একটি লেখার অনুবাদ প্রকাশ পায় ; যার শিরোনাম ছিলো— ‘আল-জাজিরা বন্ধের চেষ্টা কেন?’ লেখাটির লেখক হলেন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ইতিহাসের অধ্যাপক। দানব রাষ্ট্র ইসরায়েলের দখলদারির কথা দুনিয়ায় কাছে তুলে ধরায় নাখোশ নেতানিয়াহু যে চ্যানেলটি বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করছে, তার কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে লেখাটিতে। দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ১৭ আগস্ট ২০১৮ সালে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম ছিলো ‘আল-জাজিরার ওপর গোয়েন্দাগিরি’। সংবাদ ভাষ্যে লেখা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ) ২০০৬ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল-জাজিরার ওপর গোয়েন্দাগিরি চালিয়েছিল। চ্যানেলটির স¤প্রচার করা বিভিন্ন প্রতিবেদন নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সমালোচনা করার পরে স¤প্রচার মাধ্যমটিকে ওই গোয়েন্দাগিরির শিকারে পরিণত করা হয়।’ কাতারের সাথে সৌদির দ্বন্দ্বের যে সূত্রপাত, তার অন্যতম কারণও আল-জাজিরা। সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য কাতারকে যে শর্ত দিয়েছিলো, তার অন্যতম ছিলো আল-জাজিরা বন্ধ করা। সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনও এতে সমর্থন যোগায়। অথচ উক্ত চ্যানেলটি ২০১২ সালে বিশ্বসেরা চ্যানেল হিসেবে বিশ্বস্বীকৃতি লাভ করে। তখনকার একটি জাতীয় দৈনিকে ‘বিশ্বসেরা সংবাদ চ্যানেল আল-জাজিরা’ শীর্ষক সংবাদে লেখা হয়েছে, “আল-জাজিরা ইংলিশ বিশ্বসেরা টেলিভিশন সংবাদ চ্যানেলের মর্যাদা পেল। কাতারভিত্তিক ২৪ ঘন্টা সংবাদ পরিবেশনকারী এ টিভি চ্যানেলটি ২০১১ সালের জন্য বিশ্বসেরা নির্বাচন করেছে রয়েল টেলিভিশন সোসাইটি। সংস্থাটি বস্তুনিষ্ঠ এবং অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পরিবেশনের জন্য প্রতিবছর বিশ্বের সেরা চ্যানেলকে মর্যাদাপূর্ণ ‘রয়্যাল টেলিভিশন সোসাইটি অ্যাওয়ার্ড’ দিয়ে থাকে।” (দৈনিক আমার দেশ, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। এই যে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী খাশোগী হত্যা, যাকে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো তুরস্কের সৌদি দূতাবাসের ভেতরে, তার পেছনেও ছিলো সাংবাদিকের কলম ও কন্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার চতুর চক্রান্ত । তুরস্কের তদন্তে বেরিয়ে আসে এর পেছনে সৌদি যুবরাজ সালমানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কথা। তাছাড়া পরে সৌদি যুবরাজ নিজেই স্বীকার করেছেন স্বীয় সংশ্লিষ্টতার কথা। কিংবা উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জর কথা ধরুন। কি তার অপরাধ? তার অপরাধ সে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মিথ্যে দাবিদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশ উন্মোচন করে দেয় মর্ত্যরে মানুষের কাছে। তারপরও আশ্চর্য, পৃথিবীতে যত কুকীর্তি ও কালো অধ্যায়ের রচয়িতা হোয়াইট হাউসের দেওয়ালে কোনো কালো দাগ পড়েনা, তা হোয়াইটই থেকে যায়! বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাংবাদিকদের ওপর কতটা ক্ষ্যাপা, সেটাতো সবারই জানা। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্রের দিকে দেখুন, গত ২১ আগস্ট সোমবার সেদেশের বাসিন্দারা সকালে ঘুম থেকে উঠে কালো কালি দিয়ে ঢেকে দেওয়া সংবাদপত্র হাতে পায়। একটি বা দুটি নয়, বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র সেদিন এভাবে প্রথম পাতা কালো কালি দিয়ে ঢেকে দিয়ে প্রকাশ করে। তারা শুধু কালি দিয়ে ঢেকেই দেয়নি, পত্রিকার ওপরের দিকে ডান পাশে লাল রঙের একটি সিলও মেরে দিয়েছিলো। সেই সিলের মধ্যে সাদা হরফে লেখা ছিলো- ‘সিক্রেট’। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করার সরকারি প্রচেষ্টার প্রতিবাদে দেশটির প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলো অভিনব এই উদ্যোগ নেয়। সভ্যদেশ হিসেবে পরিচিত অষ্ট্রেলিয়ায় সংবাদমাধ্যমের যদি হয় এই হাল, তাহলে অন্য দেশসমূহের অবস্থা যে আরো বেহাল, তা না বললেও বোঝা যায়। বাকস্বাধীনতার এই বেহাল দশা দেখে মনে পড়ছে একজন কবির একটি কবিতার কতিপয় লাইন। কবির নাম এ মুহূর্তে মনে না আসলেও তার লেখা লাইনগুলো এখনো মনে আছে। কবি লিখেছেন-
প্রকৃতিতে নিষেধের বেড়া নেই,
প্রতিদিন ফুল ফোটে, হাওয়া ছোটে ;
পাখিরা যায় উড়ে দূর দূর দেশে,
কোথায় সীমানা তার বল?
রাজনৈতিক আনুগত্য সাংবাদিকতাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেকথা বইটির লেখক মাহফুজুর রহমানও তুলে ধরেছেন চিন্তাযুক্ত ও চমৎকারভাবে। তিনি লিখেছেন, “বাংলাদেশে সাংবাদিকতার আরেকটি দুর্বল দিক হলো সাংবাদিকদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন। রাজনৈতিক আনুগত্যের দ্রুত বিস্তারের কারণে এ দেশের সাংবাদিকতা সামগ্রিকভাবে অনেক দুর্বল হয়েছে।” (পৃ-২৪)। আমরা জানি রাজনীতিতে আবেগ চলে অশ্ব গতিতে। এই আবেগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিবেককে বিনষ্ট করে দেয়। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এই আবেগ অনাকাঙ্খিত ও অশনিসংকেত। তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অন্যত্র তিনি লিখেছেন, “রাজনীতিতে এখন যুক্ত হয়েছে সত্য-পরবর্তী বাস্তবতার কথা। সত্য-পরবর্তী বাস্তবতায় যে আলোচনাটি নিয়ে আসা হচ্ছে সেটি হচ্ছে রাজনীতিতে যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য। এই আবেগ যুক্তি ও তথ্যকে উপেক্ষা করছে। যুক্তি এবং তথ্যের জায়গাটি দখল করে নিচ্ছে আবেগ।… এই আবেগের চাপে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত সত্যটাই হারিয়ে যাচ্ছে।” (পৃ-১৭)। রাজনৈতিক সাংবাদিকতায় আবেগের অনিষ্টতা তো আছেই, আরো আছে গল্প তৈরির অবাস্তবতা। কিন্তু এই অবাস্তবতার স্থান নেই সত্যিকার সাংবাদিকতায়। বরং সংঘাতের সম্পর্ক সব সময়। কেননা বাস্তবতার সাথে সাংবাদিকতার সংযোগ, অবাস্তবতা হলো একটি রোগ। তারপরও মানুষ আবেগ তথা গল্পের ফাঁদে পড়ে সত্য থেকে বঞ্চিত হয়। সেকথা খুব সুন্দর ও সুনিপুণ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন বইটির বিজ্ঞ লেখক মাহফুজুর রহমান। তিনি লিখেছেন, “সাংবাদিকেরা এখন গল্প তৈরি করার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ কাজ বেশি চলছে রাজনৈতিক সাংবাদিকতায়। কারো কোনো ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারি হলে তো কথায় নেই! বিশেষ করে নারীর ক্ষেত্রে। এ জাতীয় বিষয়ে এমন সব গল্প লেখা হয়, মনে হয়ে যেন ঘটনা ঘটার সময় সাংবাদিক আশেপাশে কোথাও ছিলেন। সচেতন পাঠক বুঝতে পারেন, এটি একটি বানানো বানানো গল্প। তারপরও তারা সেসব পড়েন। কারণ তাদেরও ভালো লাগে। বেশ রসিয়ে লেখা হয় এসব গল্প।” (পৃ-৫২)। রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সাথে সাথে অপ-সাংবাদিকতা তো আছেই। মাহফুজুর রহমান লিখেছেন, “এদের (দেশের মানুষের) প্রধান ক্ষোভ মূলত তাদের অসৎ সাংবাদিকতার কারণে। দ্বিতীয় ক্ষোভ তাদের মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক আনুগত্যের জন্য।” (পৃ-৯০)। একটি সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতা যদি বিনষ্ট হয়ে যায় বা তার বারটা বেজে যায়, তখন তা আর সংবাদ থাকেনা, হয়ে পড়ে সংঘাত। সেই আর কিছু নয়, আলোর বিরুদ্ধে অন্ধকারের সংঘাত, সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যার সংঘাত, বিবেকের বিরুদ্ধে বিবেকহীনতার সংঘাত, বাস্তবতা তথা বস্তুনিষ্ঠতার বিরুদ্ধে বানানো বিবরণের সংঘাত। >> চলবে
এসবের সৃষ্টি সংবাদের প্রতি বিশ্বাসহীনতা থেকে। সেই বিশ্বাসহীনতার কথা বলতে গিয়ে তিনি নিজের এক বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন বইটির ভ‚মিকায়। তিনি লিখেন, “দেখলাম, এক ভদ্রলোক তিন-চারটা পত্রিকা ভাঁজ করে হাতে নিলেন। আমার চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোক একটু হাসলেন। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই বললেন, ‘ট্রেনে বসে বসে পড়ব। একেক পত্রিকা একেক রকম লেখে তো তাই বোঝা মুশকিল কোনটি বিশ্বাসযোগ্য।’ একজন পাঠকের এ আচরণ আমাদের বর্তমান সাংবাদিকতার ওপর তাদের অনাস্থার প্রকাশ।” (পৃ-১৫)। সাংবাদিকতার নামে এসব কাজের সাথে যারা সম্পৃক্ত, তারা সাংবাদিক নন, সাংঘাতিক। এসব কারণে সাংবাদিকদের ওপর সাধারণ মানুষ সংক্ষুব্ধ, আগের মতো বিশ্বাস করতে চায়না। কিন্তু তাই বলে তো গোটা সাংবাদিক সমাজকে দায়ী করা যায়না। সব সমাজে ভালো যেমন আছে, কালোও আছে। কিন্তু সেই কালোর কাছে ভালোকে হারলে তো চলবেনা। তাহলে এই ভবে, মানুষ হিসেবে মূল্য কি রবে? মূল্য নির্ভর করে মূল্যবোধ বা বিবেকের ওপর। এই বিবেক যদি বিকৃত বা বিক্রিত হয়ে যায়, তাহলে তারচেয়ে বদনসিবি ও বিষাদের ব্যাপার আর কি আছে! বিবেক বিক্রয়ের ব্যাপারটি কবি আল মাহমুদ খুব সুন্দর ও সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর এক সনেটে। তিনি লিখেছেন-
পূর্বপুরুষেরা কবে ছিলো কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোয়াড়,
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে ওঠে বঙ্গের বাতাস।
মুখ ঢাকে আলাওল-রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার।

অন্য একটি সনেটে তিনি লিখেছেন-

পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে
মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।

একই কথা কিছু সংখ্যক সাংবাদিক নামধারী ব্যক্তির ক্ষেত্রেও খাটে, যারা বিবেক বিক্রয় করে বাক্যের খোয়াড় বানান কিংবা মগজ বিকিয়ে দেন। তারপরও বিবেকের দুয়ার এখনো বন্ধ হয়ে যায়নি, যে কারণে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা বলতে যা কিছু বোঝায়, তা কিছুটা হলেও বেঁচে আছে। কাজটা কঠিন বটে, কিন্তু করা যাবেনা এমন নয়। কঠিন পাথর বা শিলা ভেঙে ভেঙেই তো বহু কষ্টে সোনা ও হীরা আহরণ করা হয়। আগুনে পোড়ালেই তবে সোনা খাঁটি হয়, আগুনে পোড়ালে আর তার সাথে সাথে হাতুড়ি দিয়ে পেটালে তবেই ইস্পাত থেকে তৈরি হয়ে তীক্ষ্ণ তলোয়ার। এ প্রসঙ্গে মাহফুজুর রহমান লিখেছেন, “সাংবাদিকরা যদি গণমুখী হন, বাস্তবধর্মী সাংবাদিকতা অবশ্যই সম্ভব। সে জন্য সাংবাদিকদের একটা বড় ধরনের অঙ্গীকার দরকার। একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক আনুগত্য থাকতে পারে। কিন্তু তার লেখনী অবশ্যই নিরপেক্ষ হতে হবে।” (পৃ-৫৩)। এই যে নিরপেক্ষতার কথা তিনি বলেছেন, সেই নিরপেক্ষতারও একটা পক্ষ আছে। তাই তিনি বিবেকের কথাও বলেছেন তার পরে। তিনি লিখেছেন, “বস্তুনিষ্ঠতার চর্চা শুরু হয় আসলে বিবেক থেকে। একজন সাংবাদিক যদি তার নিজের বিবেকের কাছে সৎ হন তাহলে তিনি সমাজের কাছেও সৎ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন তার কাজের মধ্য দিয়ে। বিষয়টা কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।” (পৃ-৫৩)।

প্রযুক্তির প্রাগ্রসরতা তথা বিস্ময়কর বিকাশে প্রত্যেক কিছু যেমন এগিয়েছে, তেমনি সাংবাদিকতার গতিও সমানে এগিয়েছে। আগে যেখানে ছিলো গরুগাড়ির গতি, এখন তা হয়েছে রকেট গতি। ফলে বাসি খবরের বদলে মানুষ মুহুর্তেই পেয়ে যাচ্ছে সর্বশেষ তরতাজা খবর। তথ্যপ্রযুক্তির এই তড়িৎ প্রবাহের কারণে সংবাদ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে গতি বেড়েছে ঠিকই, ক্ষতিও কম হয়নি। প্রথম ক্ষতিটা হলো- দ্রæততার দোষ। প্রযুক্তির প্রাগ্রসরতার ফলে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছ, তাতে প্রত্যেকের মধ্যে এই প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে যে, কার আগে কে কত দ্রুততম সময়ের মধ্যে দর্শক-শ্রোতা বা পাঠকের কাছে সংবাদ পৌঁছিয়ে দেবে। এই তাড়াহুড়োর কারণে তথ্যের সত্যতা যাছাই করার সূযোগ কম থাকে । ফলে অনেক সময় ভুল তথ্যও সংবাদ হয়ে প্রচার পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় ক্ষতিটা হচ্ছে, তথ্যকে সংবাদে রূপান্তরের ক্ষেত্রে যে চমৎকারিত্ব বা মুন্সিয়ানার প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রেও ঘাটতি থেকে যায়। বইটির ‘মুখবন্ধ’-এ প্রসঙ্গটির ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে ইউএনবি’র প্রধান সম্পাদক এনায়েতউল্লাহ খান লিখেছেন, “আজকাল সংবাদের প্রচার এবং প্রকাশ ঘটে অনেকটা আলোর গতিতে। এতে যেমন সুবিধা হয়েছে তেমনি সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে নানাভাবে। পাঠক-দর্শকের কাছে দ্রুত তথ্য পৌঁছে দেওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।” প্রসঙ্গটিকে পরিস্কার করতে গিয়ে মাহফুজুর রহমান তাঁর বইতে লিখেছেন, “একটা ভালো প্রতিবেদন তৈরি করতে হলে সেই নির্দিষ্ট বিষয়ে সাংবাদিককে বুঝতে হবে এবং এর সাথে সম্পৃক্ত সকলের বক্তব্য নিয়ে আসতে হবে। তড়িঘড়ি করে কাজ করার প্রবণতা বেড়েই চলেছে আজকাল। এই ডিজিটাল যুগে যোগাযোগের সুবিধা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাংবাদিকেরা এখন আর ঘর থেকে বের হতে চান না। নিজের জায়গায় বসে টেলিফোন ব্যবহার করে অনলাইন থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেন। এ জাতীয় রিপোর্ট যে সব সময় খারাপ হয় তা বলা যাবে না। অনেক সময় এতে ভালো রিপোর্টও বেরিয়ে আসে। কিন্তু মানের বিচারে কিছু ঘাটতি থেকেই যায়।” (পৃ-৩৯)।

যে কোনো সংবাদ সৃষ্টিতে সহজতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সে ক্ষেত্রে পন্ডিতির প্রয়োজন যেমন নেই, পাঠকরাও পছন্দ করেননা। সে জন্য সংবাদ লিখতে হয় সহজ ভাষায়, সংক্ষেপে ; যাতে সর্বসাধারণ তা সহজে বুঝতে পারে। কিন্তু এই সহজ করে লেখাটা যে সহজ নয়- কঠিন। তাই তো রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – ‘’সহজ কথা লিখতে আমায় কহ যে / সহজ করে যায়না লেখা সহজে।’ মাহফুজুর রহমান বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “সাংবাদিকতার গদ্য অন্য যে কোনো গদ্যের চেয়ে আলাদা। সাংবাদিকতায় বক্তব্য প্রকাশ করতে হয় সহজ-সরলভাবে। যাতে পাঠক কোথাও হোঁচট না খায়। একটা প্রতিবেদনের ভাষা হবে এতটা প্রাঞ্জল যে তথ্য-বক্তব্য ঝর্ণার পানির মতো উছলে উঠবে। সহজ করে বলার কৌশল অর্জন অনেক কঠিন কাজ।” (পৃ-১১৯)। এই কঠিন কাজ করায়ত্ত করতে হলে কি করতে হবে সেকথাও বলতে বাদ রাখেননি। তিনি লিখেছেন, “এজন্য সচেতন গদ্য চর্চার প্রয়োজন হয়। সহজ-সরল গদ্যশৈলী অর্জন তখনই সম্ভব, যখন ভাষায় সাথে একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হবে। উপন্যাস পড়তে পড়তে অনেকে ভালো বাংলা গদ্য আয়ত্তে নিয়ে আসেন। অধ্যয়নের কোনো বিকল্প নেই- বিশেষ করে শক্তিশালী লেখকের বই।”
(পৃ-১১৯)। তিনি ঠিকই বলেছেন- ভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। সত্যিই তো, কোনো কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে, কাজটিকে আনন্দের অভিজ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করতে পারলে, কাজটি যত কঠিনই হোক না কেন, কঠিন থাকেনা, সহজ হয়ে যায়।
এরপর আর কি কি যোগ্যতা বা গুণ থাকা প্রয়োজন তাও বইটির বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্ত করেছেন তিনি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “তারপর দরকার এ দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়গুলোতে পর্যাপ্ত জ্ঞান। যিনি এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতি যত ভালো বুঝবেন তিনি তত ভালো সাংবাদিক হতে পারবেন।… ভালো লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।” (২৩-২৪)। প্রসঙ্গটি প্রমাণের জন্য অন্য কাউকে পেশ করার প্রয়োজনীয়তা নেই, স্বয়ং সাংবাদিক মাহফুজর রহমানের গদ্যই তার উজ্জ্বল উদাহরণ। গদাইলস্করি গদ্যের বিপরীতে গতিময় তার গদ্য- ঝর্ণা ধারার মতো উচ্ছল, উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। এবং স্মার্টও। এই অর্জনটা তাঁর দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায়, অভিজ্ঞতা ও চর্চার ফল। এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে তাঁর সাহিত্যানুরাগ। ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু জানি, যখন তিনি গ্রামের গন্ডিতে ছিলেন, সেই পাঠ্যজীবনে পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও তাঁর প্রীতি ছিলো সাহিত্যের প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে গিয়ে তা ব্যাপ্তি লাভ করে। পাঠ্যবহির্ভূত বই, বিশেষ করে সাহিত্য বিষয়ক বই-পুস্তক পড়া ও লেখা চালিয়ে যেতেন সমান তালে। অনুবাদ করতেন, ফিচার লিখতেন ‘ঢাকা ডাইজেস্ট’ সহ বিভিন্ন কাগজে। ‘লেখকের কথা’য় সেই সোনালি অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি নিজেই লিখেছেন, “বাংলা সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনার টুকটাক অভ্যাস ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই জাতীয় কিছু লেখালেখিও হয়েছে। যেগুলো নানান জায়গায় সে সময় প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে কবি আবিদ আজাদ সম্পাদিত ‘শিল্পতরু’ অন্যতম।” পরবর্তী পর্যায়ে তিনি ‘ঢাকা কুরিয়ার’ সহ নানান জায়গায় ফিচার লিখেছেন। তাঁর মতে, ‘ফিচারে ভাষাগত বৈচিত্র বেশি।’ একদিকে সহজ-সরল ভাষার গতিময় গদ্য, অন্যদিকে ভাষাগত বৈচিত্র, তার সাথে দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলো- সবকিছুর স্মারক সাংবাদিকতা সম্পর্কিত তাঁর বইটি। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়োজন, দীর্ঘ পেশাজীবনে তিনি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেন বটে, কিন্তু পেশা পরিবর্তন করেননি। এতে তাঁর যেমন লাভ হয়েছে, তেমনি আমাদেরও। তাঁর লাভ হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা, আর আমাদের লাভ হলো সেই অভিজ্ঞার আলোয় অবগাহন করা। তাঁর পেশা জীবনে প্রবেশ বার্তা সংস্থা ইউএনবি-তে যোগদানের মাধ্যমে। মাঝে ২০১০ সালে ইউএনবি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি সান-এর বার্তা সম্পাদক হিসেবে। এবং এরপর অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ২৪.কম-এ। সেখান থেকে ইউএনবি-তে প্রত্যাবর্তন, স্বল্প সময়ের মধ্যে হয় প্রমোশন- বার্তা সম্পাদক থেকে হন প্রধান বার্তা সম্পাদক। তিন বছরের ব্যবধানে লাভ করেন প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদকের সম্মানিত আসন। এখনো পর্যন্ত সেই পদে থেকে সততা, যোগ্যতা ও নিষ্ঠার সাথে নিরলস নিবেদিত রেখেছেন নিজেকে। বোঝাই যাচ্ছে, সাংবাদিকতায় তাঁর অভিজ্ঞতা অল্পদিনের নয়, অনেকদিনের এবং সেটা কাজ করতে করতে অর্জন। অতএব বইটি যে সেই অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা, সেটা না বললেও বোঝা যায়। সূচিপত্রের দিকে চোখ বোলালেও বোঝা যায়, মূল বিষয়কে কেন্দ্রে রেখে তার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিজের বীক্ষাকে কত বিজ্ঞতার সাথে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। সূচিপত্র এই — সাংবাদিকতা কী এবং কেন, সাংবাদিকতা রাত বিরাতে, সাংবাদিকতা মাঠে ময়দানে, সাংবাদিকতা ডিজিটাল যুগে, সংবাদকক্ষ ও শ্রেণিকক্ষ, পরাবাস্তব সাংবাদিকতা, সংবাদ বোধ, সংবাদ কাঠামো, ফিচার ভাবনা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, ভাষার মুন্সিয়ানা, মন্তব্যধর্মী সংবাদ, শিরোনামই শিরোপা, ছবির চমক, সাংবাদিকের বিবেক, এজেন্সি সাংবাদিকতার ক্রান্তিকাল, সংবাদকক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাংবাদিকের গল্পগুজব, ‘আমি সাংবাদিক’, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, সাংবাদিকতার স্বপ্নসাধ, দৃষ্টির আড়ালে, ঝড়ের মুখে সংবাদপত্র – ইত্যাদি। প্রচ্ছদেও ফোকাস পেয়েছে প্রসঙ্গ বা বিষয়। বইটি প্রকাশ পেয়েছে রিদম প্রকাশনা, ঢাকা থেকে–মে ২০১৯ সালে। মূল্য রাখা হয়েছে ২৫০ টাকা। আমার মনে হয়েছে, বইটিকে মুদ্রিত মূল্যের মাধ্যমে তার মান বিচার করা যাবেনা, এটি এর ভেতরের মনিমুক্তসম লেখাগুলো নিয়েই বেশি মূল্যবান। সাংবাদিকতার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট, কিংবা অত্র পেশায় আসতে আগ্রহী, তাদের জন্য তো বটেই ; যারা এ বিষয়ে গবেষক, তাদের জন্যও গ্রন্থটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ । আমি বইটির বহুল প্রচার ও ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করি।