সহিংস সন্ত্রাসে রক্তাক্ত সভ্যতা

74

মানবজাতি আদিমযুগ পেরিয়ে সভ্যতার আলোয় নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে সেই কবে। কিন্তু এখনো সেই আদিমতার চালচিত্র পৃথিবীজুড়ে প্রকট এবং ক্রমশঃ আগের আদিমযুগকে ছাড়িয়ে নিষ্ঠুরতম অমানবিক কর্মকান্ডে মানবজাতি বেশি পরিমাণে উৎসাহী। রক্তলোলুপ জিঘাংসু বাহিনীর বর্বরোচিত সন্ত্রাস প্রতিসন্ত্রাসে সভ্যতার শরীরজুড়ে রক্তের আলপনা। প্রশ্ন জাগে মনে আমরা কোন সভ্যতায় বসবাস করছি। একবিংশ শতকে আমরা কি এ আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ সভ্যতার কাছে চরম নৃশংসতা প্রত্যাশা করেছি। এর জবাব কি আছে? সংঘাত সহিংসতায় নিমজ্জিত গোটা পৃথিবীর শান্তি ও নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে বিপন্ন। শুকোয়নি রক্তের দাগ। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্ট চার্চের ক্ষতচিহ্ন এখনও টাটকা। নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জুমার নামাজের সময় দুটি মসজিদে একযোগে আক্রমণে মসজিদে ৫০ জন নিহত হওয়ার ৩৫ দিনের মাথায় ক্ষতচিহ্ন মুছে যাওয়ার আগেই খ্রিস্টানদের পবিত্র ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় ঘটে গেলো ঘৃণ্যতম, নিষ্ঠুরতম সন্ত্রাস। নারকীয় হামলায় বিশ্বজুড়ে শঙ্কিত শান্তি প্রত্যাশী মানুষ। শান্তির দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে ৫০ জনের এই নির্মমভাবে প্রাণ হারানোর ঘটনায় বিশ্ববাসী হতবাক ও বিমূঢ় হয়েছিল ।
এ কোন সভ্যতায় আমাদের বসবাস, আমাদের জীবনযাপন ? একি সভ্যতার বিকাশ নাকি আদিম বর্বরতার প্রকাশ! উগ্রপন্থিদের উন্মত্ত হিংস্র থাবায় পৃথিবীজুড়ে আজ রক্তের হোলিখেলা চলছে। মানবিকতা ভ‚লুণ্ঠিত হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতায় শঙ্কা নিয়ে মানুষ পৃথিবীতে প্রতিটা দিন, ক্ষণ পার করছে। মানুষই জ্ঞান-বিজ্ঞানে আজ সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গেলে ও কিছু মানুষের জিঘাংসার হিংস্র থাবায় পৃথিবী আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছে।
উপাসনালয়ে প্রার্থনারত নিরীহ মানুষগুলোর কি দোষ ছিল? বিশ্ব মানবের ত্রাতা হিসেবে প্রভু যীশুর পুনরুত্থান কামনায় কলম্বোর প্রধান গির্জাগুলোতে রোববার প্রার্থনায় মিলিত হয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ খ্রিস্টীয় পরব ইস্টার দিবসে । কলম্বোর সর্বত্র ছিল উৎসবের আমেজ। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে অনন্য সুন্দর মহাসগরীয় এ দীপটিকে দেখার জন্য বাণিজ্যিক নগরীতে ভিড় জমিয়েছিলেন পর্যটকরাও। তাই উগ্রবাদীরা হত্যাযজ্ঞের জন্য বেছে নেয় সমুদ্রপাড়ের সুনসান-শান্ত শহরটিকে। ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে শ্রীলঙ্কার গির্জা ও অভিজাত হোটেলগুলো। একের পর এক বোমা বিস্ফোরণে রচিত হয় বিশ্বসভ্যতার আরেকটি মর্মান্তিক দিন। এ দিনটিই রক্তাক্ত হয় আÍঘাতীর হিংস্র থাবায়। হামলায় নিহতের তালিকায় বাংলাদেশি শিশু জায়ান সহ কমপক্ষে ৩৫ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে বইছে নিন্দার ঝড়। আক্রান্ত শ্রীলংকাকে সহমর্মিতায় সিক্ত করছে পুরো পৃথিবী। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে দেশটির ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের তিনটি বড় গির্জা সেইন্ট অ্যান্থনির চার্চ, সেইন্ট সেবাস্টিয়ানের চার্চ আর জিয়ন চার্চ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। একইভাবে মৃত্যুবিভীষিকায় পরিণত হয় কলম্বোর পাঁচ তারকা হোটেল শাংরি লা, কিংসবুরি আর সিনামন র্গ্যান্ড। মুহূর্তের মধ্যে ইতিহাসের বর্বরতম সিরিজ বোমা হামলায় মৃত্যুবরণ করেছেন তিন শ র অধিক মানুষ নিহত এবং পাঁচ শ র অধিক আহত। ইস্টার সানডের প্রার্থনা সভা প্রকম্পিত হয়েছিল সিরিজ বোমার প্রচন্ড শব্দে এবং অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদে! এ ঘটনায় শুধু শ্রীলঙ্কা নয়, হতবিহবল গোটা বিশ্ব। শোকে মুহ্যমান সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-সম্প্রদায়ের মানুষ। দুই কোটি বিশ লাখ জনসংখ্যার দেশ শ্রীলঙ্কায় ৭০ শতাংশই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। বাকিদের মধ্যে ১৩ শতাংশ হিন্দু, ১০ শতাংশ মুসলমান, আর ৭ শতাংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বসবাস করেন। শ্রীলঙ্কায় টানা ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হয় ২০০৯ সালে। সাম্প্রদায়িক সংঘাত ছাড়া গত ১০ বছর শ্রীলঙ্কা ছিল শান্ত। বহু হিংসা ও রক্তবন্যার পথ পেরিয়ে স্থিত অবস্থায় পৌঁছানোর তাগিদে একটু স্বাভাবিকতায় ফেরার প্রত্যাশায় ছিল শ্রীলঙ্কা।
পৃথিবীজুড়ে যে সহিংসতা ঘটছে তা চিহ্নিত হয়ে থাকবে সন্ত্রাস ও সহিংসতার সময়কাল হিসেবে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অরল্যান্ড নাইট ক্লাব হামলায় ৪৯ জনের প্রাণহানি ঘটে, ইস্তাম্বুলের আত্মঘাতী হামলায় মৃত্যুবরণ করে ৪৫ জন, ফ্রান্সের বাস্তিল ডে অনুষ্ঠানে ট্রাক হামলায় ৫৭ জনের জীবনহানি ঘটে, ব্রাসেলস বিমান বন্দর এবং মেট্রোরেল আক্রমণে ৩৫ জন মানুষ প্রাণ হারায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে মারাত্মক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে। লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড বা ইন্দোনেশিয়ার নাইট ক্লাবে চালানো হয়েছে বোমা হামলা। পৃথিবীর কোথাও আজ কেউ নিরাপদ নয়। ইসরায়েলি হামলায় স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি নারী-শিশু যেমন বারে বারে রক্তাক্ত নিথর হয়, তেমনি উগ্রবাদীদের বর্বরতায় নিরপরাধ মানুষ ও শিশুরা প্রাণ হারায়। মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মন্দির ভেঙে চুরমার করা হয়েছে। গির্জা আক্রান্ত হয়েছে। বৌদ্ধ মন্দির ধ্বংসলীলায় শেষ হয়েছে। রক্তপাত ও আক্রমণ থেকে মানুষ,মানবতাকে এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয় উগ্রপন্থিরা রেহাই দেয়নি। এ ঘটনাসমূহ আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের স¤পৃক্ততাকে বড় করে সামনে নিয়ে এসেছে। এমন নিখুঁত পরিকল্পিত আত্মঘাতী সিরিজ বোমা হামলার ভয়াবহতা শুধুমাত্র লঙ্কানদেরই নয়, পৃথিবীর সমগ্র মানবজাতি অবলোকন করছে যে এর পেছনে সুদক্ষ পরিকল্পনা ও বড় শক্তি কাজ করেছে; যা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী হামলারই আরেকটি নমুনামাত্র। আদিম হিংস্র অমানবিকতার ঘৃণ্য কর্মকান্ড চালিয়ে আর কতকাল মানুষ সভ্যতার অবয়বে ক্ষত সৃষ্টি করবে ? সভ্যতার আভিধানিক অর্থ যেখানে সভ্য জাতির জীবন যাত্রা নির্বাহের পদ্ধতি, সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান , দর্শন, ধর্ম, বিবিধ বিদ্যার অনুশীলনে মন ও মগজের উৎকর্ষ সাধন-সেখানে চর্চা হচ্ছে ক্রোধ, ঘৃণা, অসহিষ্ণুতার। মানুষ মানুষকে নিধন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাষ্ট্র সমূহে যুদ্ধাস্ত্রে সমরসজ্জা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উগ্রবাদী অপশক্তির মানবতাবিরোধী কর্মতৎপরতা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সব ধর্মে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য শান্তির কথা বলা আছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে শান্তি তিরোহিত হয়েছে নষ্ট ভ্রষ্ট অকল্যাণকামী কিছু মানুষরূপী শ্বাপদের হিংস্রতার কারণে। তাই মানব জাতির জন্য এখন থেকে প্রতিটা মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবতার বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণে সহাবস্থান ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনের বিকল্প নেই। সবার ঐকান্তিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় পৃথিবীতে শান্তি আনয়ন জরুরী। নইলে আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়বে সন্ত্রাসের বিষবা®প । বারম্বার রক্তাক্ত হবে সভ্যতা ।

লেখক : কলামিস্ট