সহজবোধ্য কাব্যময়তায় অনন্য কাজী কাদের নওয়াজ

48

 

কবিতায় একদিকে রবীন্দ্র-ভাবধারা ও অন্যদিকে পাশ্চাত্য ভাবধারার অনুকরনে সৃষ্ট পৃথক অন্য একটি ধারার মাঝে তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাহিত্যে তখন রবীন্দ্র বিরোধী এক যুগের সূচনা হয়েছিল। তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামও আপনধারায় ধুমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়ে নিজের অবস্থান বাংলা সাহিত্যে পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন। কবি কাজী কাদের নওয়াজ তবুও নিজেকে আলাদা ভাবেই প্রকাশ করেছিলেন।
“মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, / ইহার চেয়ে নাম যে মধুর তিন ভুবনে নাই। / সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক মাতার পরে আজি, / অন্তরে ‘মা’ থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজি।” – এটুকু জানা-নেই, সম্ভবত এমন কেউ নেই। আলোচ্য কবির লেখা থেকেই পঙকতিটুকু নেয়া। মুসলিম ঐতিহ্যে উজ্জীবিত, শিশুকাব্য ও নীতিকাব্যে বিশেষ পরিচিতি পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ। তিনি তাঁর কবিতায় সত্য-সুন্দর আর সুনীতিকে আঁকড়ে ধরেছেন, সুন্দরতম পথটি দেখিয়ে গেছেন।
‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক পাওয়া কবি কাজী কাদের নওয়াজ একাধারে শিক্ষক, কবি, বহুভাষা-পারদর্শী পÐিত, ঔপন্যাসিক ও অতি সাহসী একজন মাতৃভাষা প্রেমিক ছিলেন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারীও ছিলেন। সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের সময়ে উর্দু হরফে বাংলা লিখতে হবে, এমন ঘোষণার প্রতিবাদে এক সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত অনেকের মধ্যে তিনিই প্রতিবাদী ভাষায় বক্তৃতা করেন। বহুভাষী কবিতা তাদের স্ব স্ব ভাষায় আবৃত্তি করে বাংলায় বুঝিয়ে দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, প্রত্যেকের কাছে মাতৃভাষাই দামী।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ, শিশু-কিশোরকাব্য ও নীতিকাব্যেই অমরত্ব যাঁর। এই এক অনন্যধারায় তিনি আজও তুলনাহীন। তার কবিতায় মাতৃভক্তি, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধা, শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দেশপ্রেম ও নিঃসর্গপ্রেম সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। ছাত্রজীবনে ‘শিশুসাথী’ পত্রিকার প্রকাশিত তাঁর ‘মা’ কবিতায় মাতৃভক্তির যে স্বরূপ দেদীপ্যমান, তা তুলনীয় নয়। প্রথম দু’টো লাইন আজো বাংলার ঘরে ঘরে কাপড়ে রঙিন সুতোয় লিখে বাঁধাই করা অবস্থায় শোভিত দেখা যায়, শিশুশিক্ষার পাঠে দেখা যায়। কথাগুলো হলোঃ “মা কথাটি ছোট্ট অতি, কিন্তু জেনো ভাই, / ইহার চেয়ে নাম যে মধূর তিন ভুবনে নাই। / সত্য ন্যায়ের ধর্ম থাকুক, মাথার পরে আজি, / অন্তরে ‘মা’ থাকুক মম, ঝরুক স্নেহরাজী।” ব্যাপক সাড়াজাগানো একটি কবিতা, ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতায় তিনি মুঘল হেরেমের বিভিন্ন চরিত্র ফুটিয়ে তুলে উপস্থাপন করেছেন শিক্ষকের সম্মান বা মর্যাদার কথা। কবিতায় তারই প্রতিফলন ঘটেছে : “বাদশা আলমগীর / কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লির। / উচ্ছাস ভরে শিক্ষক তবে দাঁড়ায়ে সগৌরবে, / কুর্ণিশ করি বাদশাহর তরে কহেন উচ্চরবে- / ‘আজ হতে চির উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির / সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’’ কাজী কাদের নওয়াজের ‘হারানো টুপি’ কবিতা প্রকাশের পর সে সময়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এ কবিতা পড়ে ভ‚য়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি তাঁর ‘হারানো টুপি’ কবিতায় কবি লিখেছেন : “টুপি আমার হারিয়ে গেছে/হারিয়ে গেছে ভাইরে/ বিহনে তার এ জীবনে/কতই ব্যথা পাইরে ;” প্রবেশিকা পরীক্ষা শেষে কবির ‘ঘুমপাড়ানীয়া গান’ মাসিক ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ কবিতায় কবির কাব্য প্রতিভার দ্যুতি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘নীল কুমুদী’ কাব্যে চটুল ভাষারীতি ব্যবহৃত হয়েছে। কবি এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় পল্লী বাংলার শ্যামল প্রকৃতির অন্তরালে রূপকের মাধ্যমে ব্যক্তি হৃদয়ের স্মৃতি-বিস্মৃতি, হৃদয় বেদনা ও হৃদয়ানুভ‚তি মন্থন করেছেন। যেমন :
চাঁদ ডুবে যায় দূর নীলিমায় / শুকতারা শুধু জাগে
রজনীর শেষে, / নীল কুমুদী সে কাঁদিয়া বিদায় মাগে।” উল্লেখিত কবিতা গুলো জানানেই, এমন কোনো পড়ুয়া বাংলাদেশী এখনো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাঁর বিখ্যাত হয়ে ওঠার জন্য, পাঠক মনে আসন স্থায়ী করার জন্য এগুলোই যথেষ্ট।
কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী আল্লাহ নওয়াজ, মাতার নাম ফাতেমাতুন্নেছা। পৈর্তৃক নিবাস বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোর্ট গ্রামে। তিনি ১৯১৮ সালে বর্ধমান জেলার মাথরুন উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৯ সালে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ (অনার্স) পাশ করেন। ১৯৩২ সালে তিনি বি.টি পাশ করেন।
শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষাবিদ কবি কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৩৩ সালে স্কুল সাব-ইন্সপেক্টর পদে ও পরে কিছুদিন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ১৯৪৮ সালে মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের এক হিন্দু জমিদার বাড়ি বিনিময় করে চলে আসেন। প্রথম নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ও সবশেষ, তিনি দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৬৬ সালে অবসর গ্রহণ করেন। প্রাসাদতুল্য এই দ্বিতল বাড়িতে আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।
‘মরাল’, ‘নীল কুমুদী’, ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’, ‘উতলা সন্ধ্যা’, ‘দস্যু লাল মোহন’, ‘দাদুর বৈঠক’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি।
তৎকালীন সময়ে বহু পত্র পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে ‘মাসিক মোহাম্মদী’, ‘মাহেনও’, ‘মাসিক নবারুণ’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘বসুমতি’, ‘প্রবাসী’, ‘সপ্তডিঙ্গা’, ‘দৈনিক আজাদ’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘পাক জমহুরিয়াত’, ‘শিশু সওগাত’, ‘গণদাবী’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কবি কাজী কাদের নওয়াজ সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক ছাড়াও ১৯৬৩ সালে শিশু সাহিত্যে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, ১৯৬৬ সালে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ লাভ করেন।
১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি এ মহৎ কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তিনি তাঁর সৃষ্টিসম্ভারকে অনভিপ্রেত বাহুল্য ও দুর্বোধ্যতা মুক্ত রেখেছেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। ঐতিহ্য, প্রেম, প্রকৃতি ও স্বদেশ তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুকে অধিক তাৎপর্য দিয়েছে। সহজ-সরল ভাব ও ভাষায় রচিত তাঁর কাহিনীধর্মী এবং নীতিকথামূলক শিশুতোষ রচনার সংখ্যা অধিক। তবে সংখ্যা বিচারে নয়; নীতিকথা ও শিশুশিক্ষার বিষয়বস্তুর পাঠক-প্রিয়তার নিরিখে অল্পকিছু লেখাই তাঁকে সাহিত্যে স্থায়ী আসন তৈরী করে দিয়েছে।