সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় অভিনব জালিয়াতচক্র

338

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় তিন ধাপে পরীক্ষার্থীর ছবি থাকে। একই ছবি প্রবেশপত্র, পরীক্ষার্থীর কেন্দ্রের আসন এবং হাজিরা শিটে প্রিন্ট করা থাকে। ছবি জালিয়াতি করে ‘প্রক্সি’ রুখতে এমন পদ্ধতি অবলম্বর করেছে মন্ত্রণালয়। পরীক্ষার্থীর হাতে থাকে শুধু প্রবেশপত্র আর বাকি দুইটি ছবি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের কাছেই সংরক্ষিত থাকে। এমন কঠোর পদ্ধতির মধ্যেও অভিনব কায়দায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে প্রক্সি পরীক্ষা দিচ্ছে শক্তিশালী একটি চক্র। তিন জায়গায় একই ধরনের ছবি দিয়েই গতকাল চট্টগ্রামের একটি কেন্দ্রে প্রক্সি দিচ্ছিলেন এক তরুণ। তার নাম মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দীন সোবহান। তাকে এক বছরের কারাদÐ দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাকে ধরার পরই এমন অভিনব জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। চক্রটি নিয়োগ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছবি কিভাবে পরিবর্তন করছে তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলে প্রশ্ন উঠেছে।
গতকাল প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে এমনই এক জালিয়াতির ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ‘প্রক্সি’ পরীক্ষার্থীকে ১ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কায়সার খসরু এই আদালত পরিচালনা করেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জালিয়াতচক্র সম্পর্কে চমকে উঠার মতো তথ্য পাওয়া গেছে। চক্রটি সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মিউনিসিপ্যাল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সাহেদুল কবির চৌধুরী বলেছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেটসহ আমরা তাকে হলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করি। পরে পরীক্ষার্থীদের মনোযোগ বিঘœ ঘটবে বলে তাকে আলাদা কক্ষে নিয়ে যাই। ডকুমেন্ট দেখে আপাতত কোনোভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাছাড়া প্রক্সি পরীক্ষার্থী খুবই পেশাদার ছিলেন। হাজিরা ও বসার সিটে সাদাকালো ছবি আছে। কিন্তু প্রবেশপত্রে রঙিন ছবি। ছবিগুলোতে মূল পরীক্ষার্থীর সাথেও মিল রয়েছে। এমনভাবে টেম্পারিং করা হয়েছে, যাতে সহজে ধরা না যায় এবং মূল পরীক্ষার্থী এবং প্রক্সি পরীক্ষার্থী দুইজনের সাথেই মিল রয়েছে। পরে ম্যাজিস্ট্রেটসহ জিঙ্গাসাবাদ করা হলে এক পর্যায়ে তিনি স্বীকার করে। চক্রের আরও দুই সদস্য মামুন ও কালামের নাম বলেন। প্রথমে মামুনের মাধ্যমে কালামের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন বলে জানান তিনি। এর মধ্যে আবুল কালাম আজাদই চক্রটির মূলহোতা।
এই বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কায়সার খসরু পূর্বদেশকে বলেন, ফরিদ বাঁশখালী উপজেলার মমতাজুল ইসলামের ছেলে মো. তারিফুল ইসলামের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল। পরীক্ষা চলাকালীন বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে ম্যাজিস্ট্রেট জানতে পারেন, তারিফুল পরীক্ষার হলের বাইরে অবস্থান করছেন, তার পরিবর্তে পরীক্ষা দিচ্ছেন আরেকজন। তখন পরীক্ষা প্রায় শেষপর্যায়ে। সকাল ১১টা ২০ মিনিটের দিকে ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষার হলে গিয়ে ফরিদের প্রবেশপত্র যাচাই করে ছবি টেম্পারিংয়ের প্রমাণ পান। এক পর্যায়ে ফরিদ প্রক্সি দেওয়ার কথা স্বীকার করলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ফরিদ খুবই ধূর্ত এবং সে একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। সে প্রথমে তার বাড়ি বাঁশখালী বলে জানিয়েছে। কিন্তু তার কাছে থাকা পরিচয়পত্রের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি- তার বাড়ি কুতুবদিয়া। সে নিজেকে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে দাবি করেছে। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোন প্রমাণ তার কাছে নেই। প্রশ্ন ফাঁস ও প্রক্সি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের তথ্য দেবে বলে প্রথমে জানালেও পরে সে কোন তথ্য দেয়নি। পরে একটি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, ফরিদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র।
মূলহোতা কে এই কালাম :
আবুল কালাম আজাদের বাড়ি বাঁশখালীর পুঁইছড়ি ইউনিয়নে। মো. ফজল মাঝির ছেলে তিনি। ছিলেন পেকুয়া পোস্ট অফিসের কর্মচারী। সেখানে থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়ে গড়েছেন এক জালিয়াতচক্র। তার স্ত্রীও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করেন। দীর্ঘদিন ধরে কালাম এই সিন্ডিকেট চক্রের মূলহোতা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে এসআই নিয়োগ, শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় নিয়োগ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে বেশকিছু পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে অভিযোগের মধ্যে তার অভিনব কায়দায় চাকরি দেওয়ার সুনামও রয়েছে।

ইতোমধ্যে অনেককে সরকারি চাকরি পাইয়ে দিয়ে বিশ্বাস অর্জন করেছেন। তাই তার কাছে অনেকেই আসেন নিয়মিত। তাছাড়া এবারের প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় বেশকিছু লোকজনে কাছ থেকে চুক্তি করে টাকা নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
এলাকায় নিজেকে বাঁশখালীর বর্তমান সাংসদের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দেন। এছাড়া এমপির ব্যক্তিগত সহকারী তাজুল ইসলামের সাথে তার সখ্যতার কথা সবারই জানা। তার মাধ্যমে এমপির ডিও লেটার ও প্রক্সি পরীক্ষার মাধ্যমে সরকারি চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করেন বলে জানা গেছে। এর বিনিময়ে প্রতি চাকরির পেছনে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার চুক্তি করেন আবুল কালাম আজাদ। এই বিষয়ে কথা বলার জন্য আবুল কালামের ব্যবহৃত চারটি মুঠোফোনের নম্বরে যোগাযোগ করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন সুলাতানা পূর্বদেশকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের এত নিরাপত্তার মধ্যে এমন ঘটনা সত্যিই অবাক করার মত। নেপথ্যে কারা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যেভাবে করা হয়
জালিয়াতি

সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করার সময় জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের যে কোনো একটা দিয়ে আবেদন করা যায়। আবেদনের সময় ছবি এবং স্বাক্ষর স্ক্যান করে আপলোড করতে হয়। তখন জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আবেদন করলে ছবির সাথে মিলতে হয়। তাই এই চক্র আবেদনের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে না। জন্মনিবন্ধন সার্টিফিকেট ব্যবহার করে ‘টেম্পারিং’ করা সাদাকালো ছবি আপলোড করেন। আর ছবিতে এমনভাবে টেম্পারিং করা হয় যাতে নাক, চোখ, দাঁড়ি ও চুলে মূল পরীক্ষার্থী ও প্রক্সি পরীক্ষার্থীর মধ্যে মিল নিয়ে আসা হয়। এভাবে করার জন্য অনলাইনে ট্রেস করতে চাইলেও ধরা পড়ে না। আর স্বাক্ষরটি প্রক্সি দেওয়া ব্যক্তির স্বাক্ষর নিয়ে স্ক্যান করে আপলোড করা হয়।