সময়ক্ষেপণে মিলে না ধর্ষণের আলামত

22

ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের মামলায় ভিকটিমের মেডিক্যাল বা স্বাস্থ্য প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ষণ মামলার বিচারের ক্ষেত্রে মূলত এগুলোই হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক প্রমাণ। কিন্তু সঠিক সময়ে মেডিক্যাল পরীক্ষা না করা হলে ধর্ষণের আলামত সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। ফলে ভিকটিম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা থাকে। কিন্তু দেশের অনেক জায়গাতেই সন্ধ্যার পর স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগ হয় বন্ধ থাকে, নয়তো চিকিৎসক থাকেন না। যা সময়মতো মেডিক্যাল পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নিয়ম বদলাতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হবে। তাহলেই একজন ধর্ষণের শিকার নারীর ধর্ষণের আলামত সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে পাওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আদালতে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের মামলাগুলোতে সাক্ষীর পাশাপাশি দরকার হয় ভিকটিমের মেডিক্যাল বা স্বাস্থ্য প্রতিবেদন। মূলত এগুলোই হয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক প্রমাণ। কিন্তু সঠিক সময়ে মেডিক্যাল পরীক্ষা না করা হলে ধর্ষণের আলামত সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। তার ফলে ভিকটিমের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবার আশংকা থাকে।
ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের ঘটনার অভিযোগের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিএনএসহ অন্যান্য পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করে সেসব ফরেনসিক ল্যাব বা ডিএনএ প্রোফাইলিং সেন্টারে পাঠাতে হবে বলে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৫ সালের ২১ মে রাজধানীর কুড়িলে চলন্ত মাইক্রোবাসে এক তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে করা এক রিটের রায়ে এ নির্দেশনা দিয়েছিলেন হাইকোর্ট।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিকটিমকে যদি ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে আসা হয় তাহলে সেক্ষেত্রে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তারপরও যদি সেটা তাৎক্ষণিকভাবে করা যায় তাহলে তার ফল আরও বাস্তবসম্মত এবং প্রচুর আলামত পাওয়া যাবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ভিকটিমকে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে আনা হলে ধর্ষণের প্রমাণ বা আলামত শনাক্ত করা সম্ভব। তবে আদর্শ সময় হচ্ছে ৪৮ ঘণ্টা বা দুই দিন। এই দুইদিনের মধ্যে ভিকটিমকে যদি স্বাস্থ্য পরীক্ষার অধীনে আনা যায়, তাহলে তার সব ধরনের আলামত পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন দ্য মেডিকোলিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ-এর সভাপতি ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তাকে যদি ৪৮ ঘণ্টার ভেতরে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা যায়, তাহলে ভালোভাবে আলামত পাওয়া যায়।
আর যদি ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে যায় তাহলে কিছুটা সমস্যা হয়ে যায়, কারণ এই সময়ের মধ্যে গোসলসহ অন্যান্য কাজে পানি ব্যবহার করা হলে তখনই সে আলামত নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলেও মতামত তার।
অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা চৌধুরী বলেন, তবে এ বিষয়ে সরকার একটি পরিপত্র জারি করেছে। যাতে বলা হয়েছে ধর্ষণের শিকার নারীকে অবশ্যই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কাছে হাজির করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ঘটনার অনেক পরে ভিকটিমকে আমরা পাই, নানা জটিলতার কারণেই অনেক পরে তারা আমাদের কাছে আসে। এই পরিপত্র কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না সে বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী ও অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ধর্ষণের সময় তো কেউ সাধারণত সাক্ষী রেখে করে না, তাই ধর্ষণের ঘটনায় ভিকটিমের মেডিক্যাল প্রতিবেদনেই বড় সাক্ষী বলে গণ্য করা হয়। তাই ধর্ষণের শিকার নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ২৪ ঘণ্টা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র খোলা রাখতে হবে। থানায় আসা মাত্র তার মেডিক্যাল টেস্ট করতে হবে যাতে আলামত সংগ্রহ করতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা দিনের পর দিন বলে যাচ্ছি, সারা বাংলাদেশের যেখানে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা হয় সেটা সন্ধ্যার পর বন্ধ হয়ে যায়। তাই ২৪ ঘণ্টা সেখানে পরীক্ষা করার সুযোগ নেই বা হয় না। তার দাবি, যেখানে মেডিক্যাল পরীক্ষা করা যাবে সেখানে সবসময় চিকিৎসক থাকতে হবে, না থাকলে তারা যেন ‘অন কলে’ দ্রæত সেখানে হাজির হতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, যখনি কোনও ভিকটিম কোনও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাবে তখনই তাৎক্ষণিকভাবে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুযোগ থাকতে হবে। থানা টু মেডিক্যাল এখানে আর কোনও গ্যাপ থাকা যাবে না। থানায় যখন আসবে, তখন থানায় সেটা রুজু করতে হবে।
এলিনা খান আরও বলেন, থানা যেটা করে কেউ এলে তারা প্রথমে বলে আগে তদন্ত করতে হবে। এই যে তদন্ত করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। পরে যখন স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য যায় তখন অনেক কিছুই আলামত হিসেবে পাওয়া যায় না বা মেডিক্যাল বন্ধ হয়ে যায়।
তার দাবি, ভিকটিম আসামাত্রই মামলা রুজু করতে হবে। তদন্ত পরে হবে, আর সে অভিযোগ যদি মিথ্যা হয়, তাহলে তারা অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে পারবে। কিন্তু এই তদন্ত করার নাম করে কেউ যাতে সময় নষ্ট করতে না পারে। মামলা রুজু করাবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে এই দুটি বিষয় অত্যন্ত জরুরি। এটা যেন হয় সেই নির্দেশনা আমরা চাই।
কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, শারীরিক পরীক্ষা যদি সঠিক সময়ের ভেতরে না করা যায়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সব আলামত নষ্ট হয়ে যায়, তখন সেটা আদালতে ধর্ষণ প্রমাণ করা কঠিন। নির্ধারিত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানির সংস্পর্শে না এসে যদি ভিকটিমের মেডিক্যাল পরীক্ষা করা যায়, তাহলেই কেবল আসল ফলাফল আশা করতে পারি।