সদা হাস্যোজ্জ্বল আলম তালুকদার

24

চলমান ছড়ার দক্ষ কারিগর, সদা হাস্যোজ্জ্বল দিলখোলা হাস্যোজ্জ্বল আলম তালুকদার আর নেই। এ কথা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। টেলিফোনে লেখক, শুভানুধ্যায়ীর শোকবার্তায় কান্নার শব্দে নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। চোখের সামনে তাঁর উজ্জ্বল দিলখোলা হাসি আমাকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । এমন উদার চিত্তের মানুষগুলো এত দ্রুত চলে যান কেন ? বুঝে উঠতে পারছি না। হয়তো এটাই নিয়তি! কে কখন চলে যাবেন বিধাতা আগেই ঠিক করে রেখেছেন। তবু আমরা শোক করি। কান্নায় বুক ভাসাই। একদিন শোক কমে আসে। মুছে যায় চোখের জল। কিন্তু সেই মহান মানুষটির স্মৃতি বুকে ধরে রাখার চেষ্টা করি সারাজীবন। সারা দুনিয়ায় এই করোনা দুর্যোগে অনেক মহৎপ্রাণ মানুষকে আমরা হারিয়েছি। একটি শোক সামলে ওঠার আগেই আর একটি শোক নিয়ে মাতম করতে থাকি । এমন মাতম যেন থামতেই চাইছে না।
আলম তালুকদার চাকুরি জীবনের শেষে এসে বাংলাদেশ গণগ্রন্থাগারের মহাপরিচালকের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। মহাপরিচালক থাকাকালীন সময়ে বইয়ের প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলার জন্য তিনি ছড়ায় একটি স্লোগান চালু করেন, “পড়িলে বই, আলোকিত হই। না পড়িলে বই অন্ধকারে রই।” এই স্লোগানটি তিনি বাংলাদেশের সরকারি দপ্তর সমুহে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। মানুষ তা গ্রহণ করেছে। বড় মনের মানুষের এই শৈল্পিক, ছান্দিক উচ্চারণের বড় শক্তি ছিল বলেই সবাই তা সাদরে গ্রহণ করেছে। এখানেই আলম তালুকদারের কৃতিত্ব।
আলম তালুকদার হাঁটতে হাঁটতে ছড়া কাটতেন। মঞ্চে কথা বলতে উঠলে সেখানেও দেখেছি তাঁর ছন্দের কারিকুরি। কোথা থেকে কোন শব্দ কিভাবে যেন মিলিয়ে দিতেন তিনি। দর্শক-শ্রোতা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে হাত তালি না দিয়ে থাকতে পারতেন না। কথা শেষ করেই ছন্দ মিলিয়ে বলতেন, “সবাইকে না দিয়ে বাদ, আপনাদের ধন্যবাদ।” আবার শুরু হয়ে যেত হাততালি।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের যেখানেই তাঁর সাথে দেখা হয়েছে এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করেছেন। তাঁর ভেতরে কোন রকম অহমিকা বা গরিমা লক্ষ্য করিনি। ছড়া অন্তপ্রাণ, শিশুমনস্ক এমন মানুষ আর পাওয়া যাবে না বলেই আমাদের বুকের শূন্যতা, হাহাকার চাড়া দিয়ে উঠছে বার বার।
আমাদের সমাজে এমনিতেই ভালো মানুষের সংখ্যা খুব কম। আলম তালুকদারের মত ভালো মানুষ আর কখনো পাবো না। সারাজীবন লেখালেখিতে লেগে থাকা, শিশুর মত সরল আলম তালুকদারের বইয়ের সংখ্যা শতকের কাছাকাছি। এর ভেতর সিংহভাগ বই-ই ছোটদের জন্য লেখা। ছোটদের তিনি খুব ভালবাসতেন বলেই শিশুসাহিত্যের বই লিখেছেন বেশি। শিশুদের জন্য লেখা বইগুলোর নাম দেখলেই বোঝা যাবে তাঁর শিশুমনের পরিচয়। এরকম বইয়ের নামগুলো দেখা যাক-
‘ঘুম তাড়ানো ছড়া’, ‘খোঁচান ক্যান’, ‘চাঁদের কাছে জোনাকি’, ‘ডিম ডিম ভূতের ডিম’, ‘ঐ রাজাকার’, ‘যুদ্ধে যদি যেতাম হেরে’, ‘বাচ্চা ছড়া কাচ্চা ছড়া’, ‘ছড়ায় ছড়ায় আলোর নাচন’, ‘জাদুঘরের ছড়া’, ‘ছড়ায় ছড়ায় টক্কর’, ‘ছড়া সমগ্র’ ‘মহাদেশ বাংলাদেশ উপদেশ’, ‘শিশুদের শিশুটামি’, ‘অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা’, ‘নাই দেশের রূপকথা’, ‘ভূতের সঙ্গে ভূত আমি’, ‘কিশোর সমগ্র’, ‘গল্প সমগ্র’ প্রভৃতি।
লেখালেখিতে তিনি যে সব পুরস্কার পেয়েছেন –
পালক অ্যাওয়ার্ড ১৯৯৬, চোখ সাহিত্য পুরস্কার ২০০০, অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪০৫, জসীমউদ্দীন পুরস্কার ২০০১, কবি কাজী কাদের নওয়াজ পুরস্কার ২০০৪, স্বাধীনতা সংসদ পুরস্কার ২০০৬, অলোক আভাষ সাহিত্য পত্রিকা পুরস্কার ২০০৬, শিল্পাচার্য জয়নুল পুরস্কার ২০০৮, সাহস সম্মাননা ২০১০, ফুটতে দাও ফুল সম্মাননা পদক ২০১১ ইত্যাদি। সাহিত্যে জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখার জন্য টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার লাটাই ছড়াসাহিত্য পুরস্কার ২০১৫ পেয়েছেন তিনি।
আলম তালুকদার আজ নেই। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মে। তাঁর অমলিন হাসিতে। তাঁর স্বভাবসুলভ আচরণের উজ্জ্বলতর স্মৃতিতে তিনি আমাদের মনের মণিকোঠায় থাকবেন চিরকাল। তাঁর লেখাগুলো যত বেশি পাঠ করবো তত বেশি আমাদের মাঝে অমলিন থাকবেন তিনি। এসো, মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই তিনি যেন আলম তালুকদারকে বেহেস্ত নছিব করেন।