সত্যের সাধনায় মুসলমান

18

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের নাম। জীবন-যাপনের সকল বিষয় ইসলামে বিধৃত আছে। তাই সকল মুসলমান ইসলামের জীবন বিধানের অনুসরণ করা একান্ত কর্তব্য। আমরা সকলেই জীবনকে সুন্দর ও স্বার্থক করতে চাই। এতে সফল হতে হলে সুন্দর নিয়ম নীতিগুলোরই অনুসরণ একান্ত প্রয়োজন। এ সকল সুন্দর নিয়মগুলো অনুসরণে ব্যর্থ হচ্ছি বলে দায়িত্বে অবহেলা, ওয়াদা খেলাপ, খারাপ আচরণে সমাজ আজ পিষ্ট হচ্ছে। মানুষের কাছে সত্যবাদিতা লোপ পাচ্ছে। মানুষের কাছে মনুষ্যত্বের গুণাবলী না থাকলে সে কীভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ হতে পারে! সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ মানুষই সমাজে মাথা উঁচু করে সম্মানের সাথে জীবন অতিবাহিত করতে পারে। মহৎ মানুষেরা যুগে যুগে সত্যের সাধনায় জীবনকে হাসি মুখে করেছে উৎসর্গ। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক ‘আর্নেস্ট হেমিং হোয়ে’র বিখ্যাত কথা, মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না’। পৃথিবীর অনেক মহামানবকে হত্যা করা হয়েছে কিন্তু তাদের আদর্শকে হত্যা করা যায়নি। সত্যের মৃত্যু নেই, সত্য সত্যই থাকবে মহাপ্রলয়ের শেষ রজনী পর্যন্ত।
সমাজে সুবিধাবাদী, স্বার্থপর মানুষরাই মিথ্যার কাছে নিজের বিবেককে বন্দী রেখে ফায়দা গ্রহণ করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে ন্যায়বান সত্যবাদীরা সমাজে সুখী থাকে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, ‘যারা ঈমান এনেছে এবং পুণ্যকাজ করে তাদেরকে আল্লাহ প্রতিশ্রæতি প্রদান করেছেন ক্ষমা ও মহাপুরস্কারের’। (সূরা মায়িদা, আয়াত : ৯)
সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন চলা এক বড় কঠিন জিহাদ। এই জিহাদে বিজয়ী হতে কঠোর সাধনার প্রয়োজন। সত্য ও শান্তির জন্য প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আল-আমিন’ উপাধি অর্জন করেছিলেন। মিথ্যাকে চরমভাবে ঘৃণা করতেন তিনি। মিথ্যাবাদীরাই সব পাপাচার করতে পারে বলে তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘মিথ্যা সকল গুণাহের মূল’। সত্যের শক্তি অসীম। সত্যের দ্বারা শত্রæকেও পরাজিত করা যায়। মিথ্যা চর্চায় মানুষের মন ছোট হয়ে যায়। কোন সমাজ ও দেশের উন্নতি করতে হলে সততা পূর্বশর্ত। প্রিয়নবী (দ.) বর্ণনা করেছেন, ‘মানুষের রিজিক ৯০ ভাগ আসে ব্যবসার মাধ্যমে’। ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা মহাপুণ্যের কাজ। তাই মহানবী ইরশাদ করেছেন, ‘যে সততা ও আমানতদারীর সাথে ব্যবসা করেন, তিনি কেয়ামতের দিন নবী, সিদ্দিক ও শহীদানদের সাথে থাকবে’।
হালাল রুজি পরিবারের জন্য আল্লাহর পথে জিহাদের সমতুল্য। মুনাফালোভী, কালোবাজারি, মজুদদারীর মাধ্যমে অধিক অর্থ উপার্জন করে রাতারাতি ধনী হওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। তাক্ওয়া বা খোদাভীতি থাকলে মানুষ এ সকল অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি থেকে দূরে থাকে নিশ্চয় জান্নাতে হবে তাঁর অবস্থান’। সূরা : নাযিয়াত, আয়াত : ৪০-৪১)
বিখ্যাত মুসলিম চিকিৎসক ইবনে সিনা বলেছেন, ‘আল্লাহর ভয় সকল ভয় হতে মানুষকে মুক্তি দেয়’। সততার মাধ্যমে আত্মোন্নয়ন ঘটে। সমাজকে সুন্দর করতে হলে সত্যের চেতনায় দেশপ্রেমিক হতে হবে। সৎ কাজের নির্দেশ দেওয়া আল্লাহর হুকুম। পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, ‘নামাজ প্রতিষ্ঠা কর, সৎ কাজের আদেশ প্রদান এবং অসৎ কাজে নিষেধ কর’। (সূরা : লুকমান, আয়াত : ১৭)
পরিবারের সৎকর্ম ও সততার শিক্ষা শিশুদের প্রদান না করলে তারা জীবনে সত্যবাদী কখনো হতে পারবে না। সে জন্য প্রয়োজন পরিবার হতে সত্যের সাধনার চর্চা করা।
সুন্দর চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের কারণে অনেক মানুষ আল্লাহর কামিল বান্দায় পরিণত হয়েছে। গাউসে পাক আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) মায়ের নির্দেশ অনুসারে ডাকাতের কাছে সত্য কথা বলে ডাক্তারদের ভক্তে পরিণত করেছিলেন। সত্যবাদীরা অঙ্গীকার রক্ষা করে চলেন। আমানত খেয়ানত করে না। প্রিয়নবী (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তির নিকট আমানতদারী নেই তার ঈমানও নেই। যে অঙ্গীকার রক্ষা না করে তার কাছে ধর্ম নেই।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা প্রতিশ্রæতি পালন করবে; প্রতিশ্রæতি সম্পর্কে কৈফিয়ত চাওয়া হবে’। (সূরা : বনী ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)
মহানবী (দ.)’র নবুয়ত প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে আবদুল্লাহ ইবনে আবু আসমা ব্যবসায়িক কাজে নবীজীকে এক স্থানে অবস্থান করতে বলে সেখান হতে চলে গেলেন। পুনরায় তিনি সেখানে ফিরে আসতে ভুলে গেলেন। তিনদিন অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি ফিরে এসে দেখলেন মহানবী (দ.) প্রতিশ্রæতি রক্ষার জন্য সেখানে বসে আছেন। প্রতিশ্রæতি রক্ষা করা ইসলামের নবীর মহান শিক্ষা। সে শিক্ষা আত্মস্থ করতে ব্যর্থ হচ্ছি বলে আজ মুসলমান সমাজের অধঃগতি। মুসলমানরা সত্যবাদী প্রতিশ্রæতিশীল নবীর উম্মত। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মোনাফিকের কাজ। যে অঙ্গীকার পালন করা সম্ভব নয় সে অঙ্গীকার প্রদান করা ইসলাম অনুমোদন করে না। অঙ্গীকার ভঙ্গ করা মোনাফিকদের কাজ। মোনাফিকদের স্থান জাহান্নামের নিম্নস্তরে। আল্লাহর রাসূল (দ.) ইরশাদ করেছেন, ‘মোনাফিকদের পরিচয় তিনটি ১) মিথ্যা কথা বলা ২) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ৩) আমানত খেয়ানত করা।
সত্যবাদী মুসলমানের আচার-আচরণে সমাজ জাতি রাষ্ট্রের সর্বোত্তম কল্যাণ সাধিত হয়। সত্যবাদীরা স্বীয় পরিবারেও উত্তম ব্যবহার করে থাকে। প্রিয়নবী (দ.) বর্ণনা করেছেন, যে ব্যক্তি নিজের স্ত্রীর সাথে ভালো ব্যবহার করে সে সর্বোত্তম। যে পরিবারের কাছে উত্তম সে আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির কাছে উত্তম। তিনি ইরশাদ করেছেন, ‘সে প্রকৃত মোমিন নয়, যে নিজের জন্য যা কামনা করে তা অপর ভাইয়ের জন্য কামনা করে না’। নবীজী আরো ইরশাদ করেছেন, ‘নিকৃষ্ট কারা তা বলে দিব কি ? সাহাবীগণ বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, যারা নিজে খায়, দাস-দাসীদের বেত্রাঘাত করে এবং কোন মানুষকে কিছু দান করে না’। তিনি একথাও বলেছেন, ‘মুসলমানদের ঘরসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ঘর হলো যে ঘরে এতিম রয়েছে। (সোবহানাল্লাহ)
আল্লাহ রাসূলের সত্যের পথ অনুসরণ করে অন্যায় অবিচার হতে মুক্ত থেকে প্রকৃত মুসলমান হতে পারলে সমাজ সুন্দর হতে বাধ্য। আজ যখন দেখি মুসলমান হয়ে মোনাফেকী, মীর জাফরী, বেঈমানি করছে তখন ব্যতীত চিত্তে ভাবি আমাদের এমন হলো কেন? আমরা তো সুন্দরতম মহানবীর শ্রেষ্ঠতম উম্মত। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে চাই, ‘ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ তোমার দেখানো পথ’।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক