সক্রিয় বৃষ্টিবলয়ে বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টির আভাস

84

চৈত্রের মাঝামাঝিতে পারদ চড়ার সাথে সাথে দেশের কয়েকটি অঞ্চলে ইতিমধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে সক্রিয় হয়েছে বছরের প্রথম শক্তিশালী পূর্ণাঙ্গ বৃষ্টিবলয়। এর প্রভাবে গতকাল শুক্রবার বিকাল থেকেই রাজশাহী, রংপুর, খুলনা ও সিলেট অঞ্চলের বেশকিছু এলাকার উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার খবর মিলেছে। বৃষ্টিবলয়ের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থান আজও অব্যাহত থাকলেও আগামীকাল রবিবার থেকে তা বজ্রঝড়, শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখীর আকারে দেশজুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। যা অব্যাহত থাকতে পারে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের একেবারে শেষ পর্যন্ত। ফলে, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতির পাশাপাশি বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
পূর্বাভাস বলছে, আবহাওয়ার বিরাজমান বৃষ্টিবলয় আজ শনিবার পর্যন্ত দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে পুনরায় বিক্ষিপ্তভাবেই সক্রিয় থাকতে পারে। তবে, আগামীকাল রবিবার থেকে ৮ এপ্রিল পর্যন্ত এটি সর্বোচ্চ মাত্রায় বিশেষভাবে সক্রিয় থাকতে পারে। এর প্রভাবে দেশের অধিকাংশ এলাকায় কালবৈশাখী, ভারী বৃষ্টি এবং কিছু এলাকায় শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এটি সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয় থাকাবস্থায় দেশের বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায় ঘন্টায় প্রায় ৬০ থেকে ৮০কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকায় ঝড়ো হাওয়ার গতিবেগ ঘন্টায় ৯০কিলোমিটারও ছাড়িয়ে যেতে পারে। ওই সময়ে দেশের আকাশ আংশিক থেকে প্রধানত মেঘলা থাকতে পারে। একই সময়ের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু এলাকায় শিলাবৃষ্টিরও আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আরিফ হোসেন গতকাল শুক্রবার পূর্বদেশকে বলেন, ‘শীতের বিদায়ের পর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়ছে। ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা সাড়ে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। মার্চ ও এপ্রিল মাস হচ্ছে দেশের আবহাওয়ার স্পর্শকাতর সময়। এই সময়ে খরতাপ, বজ্রঝড়, শিলাবৃষ্টি ও বন্যা হয়ে থাকে। তাই এখন প্রকৃতিতে এর যে কোনও ধরনের উপস্থিতি দৃশ্যমান হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে, সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতির পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের এখনই সময়।’
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টার জন্য প্রকাশিত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পশ্চিমা লঘুচাপের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলসহ রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, ঢাকা ও বরিশাল বিভাগের দু’এক জায়গায় অস্থায়ী দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে, সেই সাথে কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টি হতে পারে।
এছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে ও রাতের তাপমাত্রা এক থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। পরবর্তী দু’দিন বা ৪৮ ঘন্টায়ও বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল শুক্রবার দেশের সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের মাদারীপুরে।
এর আগে শীতের বিদায়ের পর বসন্তের প্রথম সপ্তাহেই আগাম কালবৈশাখীর জানান দিয়েছে প্রকৃতি। চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমের প্রথম তুমুল শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড় কেড়ে নিয়েছে দুই শিশুসহ চারজনের প্রাণ। আমের মুকুল, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসলের বুকে রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের আগাম কালবৈশাখীর প্রথম শিলাবৃষ্টির ধরন স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘চোখ কপালে’ তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীর পুঠিয়ায় শিলাবৃষ্টির তান্ডবলীলার সাক্ষী হয়ে স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, বিগত ৬০ বছরে এমন ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি তারা আগে কখনও দেখেন নি। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোরের এই শিলাবৃষ্টির অসংখ্য ছবি এবং ভিডিওচিত্র গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছবিগুলোর দিকে তাকালে দেশের প্রত্যন্ত জনপদের যে কোনও মানুষের চোখ হঠাৎ করে আটকে যেতেই পারে বিস্ময়ে! এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। দেখে মনে হবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মত শীতপ্রধান কোনও দেশের তুষারপাতের দৃশ্য। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা এতোটাই বেশি ছিল যে, গ্রামগুলোতে টিনের চাল ছিদ্র হয়ে ঘরেও শিলা ঢুকে যায়। শিলাবৃষ্টি থামার তিন ঘণ্টা পরও বাইরে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছিল না।
স্থানীয়রা কোদাল দিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া শিলা সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করে। ৩৮ মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টিতে ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দিল্লিতে অনেকটা একই ধরনের শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়াশা-দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দিল্লিতে শিলাবৃষ্টি কখনো-সখনো হয়, কিন্তু এত তীব্র শিলাবৃষ্টি শহরের অনেক বাসিন্দাই আগে দেখেননি। সাথে সাথেই শোরগোল পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। বহু লোক ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটস অ্যাপে শিলাবৃষ্টির ছবি ও বরফ-ঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালানো কিংবা হৈ-হুল্লোড়ে মাতামাতির ছবি পোস্ট করতে থাকেন।
অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদী পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, মার্চ মাসে ক্রমান্বয়ে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। তাপমাত্রা বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। তবে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা ৩৭ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে। একইভাবে এই মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার আলামত বিদ্যমান রয়েছে। এছাড়া, দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে এক থেকে দুদিন মাঝারি অথবা তীব্র কালবৈশাখী ও বজ্র-ঝড় এবং অন্যত্র দুই থেকে তিন দিন হাল্কা থেকে মাঝারি কালবৈশাখী ও বজ্র-ঝড় হতে পারে। এরপর এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়ে তার মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে পূর্বাভাসে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে, গতবছর একই সময়ে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই ওঠানামা করেছে। উল্লেখ্য, এশিয়া অঞ্চলের আবহাওয়াবিদরা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রাকে তীব্র তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি এবং ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু তাপপ্রবাহ হিসেবে গণনা করেন।