সকল প্রতিকূলতাকে জয় করেই মানুষ যুগে যুগে এতোদূর পথ এগিয়ে এসেছে

72

রতন কুমার তুরী

পৃথিবী সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ সকল প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কখনও প্রকৃতি, কখন মানবসৃষ্ট যুদ্ধ, আবার কখনও ব্যাভিচারি শাসকদের পরাকাষ্ঠা থেকে যুতবদ্ধ সংগ্রামের ফলে মানুষের মুক্তির সাফল্যগাঁথার ইতিহাস চিরকালিন। বলতে গেলে হাজার প্রতিক‚লতার মাঝে মানুষের জয়গানই ইতিহাসে যুগে যুগে লিখিত। একেবারে আদিমকালের গুহাবাসী মানুষ থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক সভ্যতার মানুষ সবারই রয়েছে প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। মানবজাতি প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ব্যাপক মানুষ প্রাণও হারিয়েছে তবুও তারা এগিয়ে গেছে সামনের দিকে। মানবজাতির আদিম স্বভাবই হচ্ছে সকলেই একসাথে বৈরী পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করা। আর এই কারণেই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র প্রথা। এসব নিয়ম মুলতঃ মানুষকে একাতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করার জন্য এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে একে অপরের পাশে থেকে জীবনকে অতিবাহিত করার জন্য। এমন নিয়মের মধ্যেই পৃথিবীর মানুষ আজ পর্যন্ত তাদের জীবনের সব কার্যাদি সম্পাদন করে আসছে। প্রকৃতপক্ষে সমাজ সংসারহীন মানুষ এ জগতে নিতান্তই কম। মানুষের বেশিরভাগ চিন্তাই আবর্তিত হয় সমাজ এবং সংসার নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে আদিম মানুষ যখনই বুঝতে পেরেছিল যে মানুষ কখনও একা একা বসবাস করতে পারেনা এবং মানুষকে বিভিন্ন অপশক্তি কিংবা নির্মম প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে একাতাবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে হবে ঠিক তখনই তারা গোষ্ঠীগত হয়ে একাতাবদ্ধ হতে লাগলো। এক্ষেত্রে তারা প্রথম লড়াই শুরু করেছিল গভীর বনজঙ্গলের হিংস্র পশুদের বিরুদ্ধে। নগর সভ্যতা শুরুর আগে মানুষ বনজঙ্গলে বসবাস করত এবং পশু- পাখি শিকার করে খেতো এবং পশুদের চামড়াও পরিধান করতো। অনেক সময় হিংস্র পশুদের শিকার করতে গিয়ে নিজেরাই পশুদের শিকার হয়ে যেতো। তারপরও কিন্তু মানুষ হাল ছাড়েনি তারা একাতাবদ্ধ হয়ে জঙ্গলের গুহায় বাস করে পশু- পাখি শিকার করে জীবন ধারণ করে এগিয়ে যেতে লাগলো। তারপর তারা আস্তে আস্তে আগুন জ্বালাতে শিখলো এবং বন জঙ্গলকে পরিষ্কার করে কৃষি কাজ করতে শিখলো তখনও কিন্তু মানুষ একসাথেই পথ পাড়ি দিয়েছিল। মধ্যযুগে এসে পৃথিবীর আশাতীত পরিবর্তন হলেও অনেক মানুষের মধ্যে আবার মানবিক দৈন্যতা লক্ষ করা যায় ফলে পৃথিবীতে মধ্যযুগকে এক আঁধার হিসেবে দেখা হয়। সেই যুগেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এক হয়ে কাজ করেছে মানুষের জন্য। মুলকথা প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত পৃথিবী লক্ষ কোটি বছর অতিক্রম করেছিল এই মানুষেরই বিভিন্ন কর্মদক্ষতায়।
উল্লেখ্য যে পৃথিবী সৃষ্টির পর মানুষের জন্য সবচেয়ে দুর্যোগপূর্ণ এবং বৈরী যুগ ছিল উপরোক্ত দু’টি যুগ কারণ তখনও পৃথিবী সেইভাবে উন্নত হয়নি। তারপরও মানুষ কত হাজার প্রতিক‚লতাকে জয় করে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই। প্রাচীন ও মধ্যযুগ অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে নাম নাজানা বিভিন্ন রোগে তখন তো মানুষ জানতোই না ওষুধ কাকে বলে বিভিন্ন বনজ ওষুধ খেয়ে মাঝে মধ্যে রোগ সারলেও তা ছিল ঠুনকো রোগ। জটিল রোগগুলোতে মানুষ হরহামেশাই মারা যেতো। তবুও মানুষ এতটুকু বিচলিত না হয়ে একাতাবদ্ধ হয়ে এসব রোগ শোকের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে। আধুনিক যুগে এসে মানুষকে কম লড়াই করতে হয়নি। উন্নত দেশগুলো নিজেদের আদিপত্য বজায় রাখার জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে থাকে আর সেই যুদ্ধ থেকে তারা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটে নিতে গিয়ে বহু অমানবিকতার আশ্রয় নিতে থাকে সেই অমানবিকতারও জবাব মানুষ দিয়েছে একাতাবদ্ধ হয়ে। মানুষের একাতাবদ্ধ লড়াইয়ের ফলে পৃথিবী থেকে অনেক স্বৈরশাসকসহ বিভিন্ন সরকার ব্যবস্থার পতন ঘটেছে। সমাজতন্ত্র আজ পৃথিবী থেকে প্রায় বিলীন। একসময়ে রাজতন্ত্রে ভরা পৃথিবী আজ গণতন্ত্রে ভরে গেছে। এসব মানুষই গড়েছে আবার মানুষের প্রয়োজনে মানুষই এগুলোকে বর্জন করেছে। আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগেও লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে মানুষেরই হাতে যার জলজ্যান্ত উদাহরণ ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যে যুদ্ধে পৃথিবীর সুসভ্য দেশ নামে খ্যাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের মাটিতে আনবিক বোমা নিক্ষেপ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। সেদিনও জাপানের মানুষ সম্মিলিতভাবেই এই প্রতিক‚লতা কাটিয়ে উঠেছিল। এর পরবর্তিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক দেশ স্বাধীন হয়েছে ঝড়েছে অসংখ্য মানুষের রক্ত তবুও মানুষ এগিয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে আমাদের এই ক্ষুদ্র দেশটি স্বাধীন হওয়ার আগে ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পাক শাসক গোষ্ঠী তবুও এদেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে এই পৃথিবীর বুকে।
বাংলাদেশ নামের আরো একটি নতুন দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়ে এদেশের মানুষই প্রমাণ করেছে মানুষই পারে সকল প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্টার। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মাঝে লুকিয়ে আছে অসীম সহ্য শক্তি আর প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে লড়াই করার দৃঢ় মনোবল আর তাই যুগে যুগে সব প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে মানুষরই জয় হয়েছে। বর্তমান সময়ে পৃথিবীর দেশে দেশে চলমাম মহামারির বিরুদ্ধেও মানুষ অবশ্যই জয়ি হবে। আবার পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই মানুষের পদভারে মুখরিত হবে পৃথিবী। আসুন পৃথিবীর আদি রীতি অনুসরণ করে মনুুষ্য শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সবাই একসাথে মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই করি এবং পৃথিবীতে আবারও মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ করি। আমাদের সবার মনে রাখতে হবে এই বিশ্ব চড়াচড়ে রোগ শোক নিত্য বহমান এদের বিরুদ্ধে লড়াই করেই মানবজাতিকে সবসময় এগিয়ে যেতে হবে। এদের নির্মূলের জন্য যেমন প্রয়োজন রয়েছে মানুষের নিরলস প্রচেষ্টা, তেমনি প্রয়োজন রয়েছে সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ এই দুইয়ের মেলবন্ধনের মাঝেই রয়েছে মানুষের মুক্তি এবং মহামারিসহ বিভিন্ন অশুভ শক্তির পরাজয়। তাই আসুন হতাশা নয়, নব উদ্যমে মানসিক শক্তিতে বলিয়ান হয়ে আমরা সবাই চলমান মহামারির মোকাবেলা করি।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক