সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন

223

পানি আমাদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ। পানি সম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক ব্যবস্থাপনা, সুনিপুন পরিকল্পনায় পরিশোধন, রক্ষণ, ব্যবহারে সক্ষমতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ক.চধৎশ এর মতে, নিরাপদ পানি বলতে সেটা হবে রোগজীবানুমুক্ত, যেখানে নেই কোনো ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ, রং এবং গন্ধমুক্ত ও খেতে হবে সুস্বাদু। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ পানি সরবরাহে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে। অধিকাংশ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮৭ শতাংশ, ভুটানে ১০০ শতাংশ, ভারতে ৯৪ শতাংশ, নেপালে ৯২ শতাংশ ও মালদ্বীপে ৯৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করছে।
জনাধিক্যতা, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন প্রকৃতির ভারসাম্যতা নষ্ট করছে। নগরে জনসংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। জনসংখ্যানুযায়ী পানির চাহিদাও বাড়ছে। তৎপ্রেক্ষিতে পানির উৎপাদন বৃদ্ধি আবশ্যক। খাবার পানি নিয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে সীমাহীন অজ্ঞতা, অসততা ও অসতর্কতা। নদীময় বাংলাদেশে প্রাকৃতিক কারণে নয় বরং মানবসৃষ্ট কারণে নদী, খালবিল, জলাশয়গুলোর মধ্যে অধিকাংশই মৃতপ্রায়। সবার জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে পানির উৎসসমূহ পরিচ্ছন্ন রাখা ও বাঁচিয়ে রাখা জরুরী। বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ জনস্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। নিরাপদ পানির ক্ষেত্রে সেবার পরিধি বিস্তৃত করার পাশাপাশি সেবা প্রদান প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশের বড় বড় শহরের আশেপাশে নদীগুলো শিল্প, পয়ো ও পৌর বর্জ্য দ্বারা অতিমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। এই দূষণের প্রায় ৬০% শিল্পকারখানা থেকে নদীতে নির্গত হয়। ফলশ্রুতিতে এই পানি সাধারণ পদ্ধতিতে পরিশোধনের অযোগ্য হয়ে পড়ে। একেক এলাকায় পানির সমস্যা একেক রকম। দেশের সকল মানুষকে সুপেয় পানির আওতায় আনতে আর্সেনিক এবং উপকূলীয় ও পার্বত্য এলাকার পানি সরবরাহ সমস্যার সমাধানে বহুমাত্রিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
কৃষিকাজে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ এবং শিল্পকারখানার রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহারে প্রতিনিয়ত মিঠা পানির উৎসে সংযোজিত হয়ে পানিকে ক্রমাগত দূষিত করে যাচ্ছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। এখনো ৪২ শতাংশ বাসাবাড়ির পানিতে রোগজীবানুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। লবণাক্ততা বেড়েছে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের জেলাগুলোতে। সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলাগুলোতে সুপেয় পানি দুর্লভ হয়ে পড়েছে। জীববৈচিত্র্য, প্রকৃতি ও বন ধ্বংস হওয়ার ফলশ্রæতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় ছড়া ও ঝরনা শুকিয়ে গেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম’র মানুষকে পানি সংকটে নিপতিত করেছে।
সুপেয় পানি সংক্রান্ত কিছু বিষয়াদি আলোচনায় রাখা দরকার যেমন-স্বাভাবিক পানি প্রবাহে হস্তক্ষেপ, ভূ-গর্ভস্থ পানি ও তার সমস্যা, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শহরে পানীয় জলের সংকট, লবণাক্ত পানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানীয় জলের ওপরে এর প্রভাব, পানি দূষণ, আর্সেনিক দূষণ, পানীয় জলের সংকটে বহুজাতিক কোম্পানি ও ব্যক্তিগত মালিকানায় পানি ব্যবসার প্রভাব, পানির ওপর মানুষের অধিকারের ধারণা, পরিশোধনের অত্যাধুনিক ব্যবস্থা, ভূ-পৃষ্ঠস্থ ও ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎসের দূষণ প্রক্রিয়া, ব্যবহৃত পানির রি-সাইকেল বা পুনরায় শোধনের পর পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করা। যেসব প্লাস্টিক বোতলের পানি নিরাপদ পানি হিসেবে আমরা পান করি সেটা গুণগত মান ও কতটা নিরাপদ তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার। সুপেয় পানির উৎস নদীগুলোর সকল ধরণের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ পূর্বক নদীখেকোদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতে সরকারের আরো কঠোর হতে হবে। সিঙ্গাপুর’র স্বাধীনতার পর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিলো খাবার পানি সমস্যা। সাগরবেষ্টিত সিঙ্গাপুর দেশটিতে সাগরের পানি নোনা হওয়ায় সেই পানি পান ও প্রাত্যহিক ব্যবহারে অযোগ্য ছিল। পানির এই মারাত্মক সমস্যা নিরসনে দেশটি দূর থেকে বরফের বড় বড় টুকরা সাগরের পানির মধ্য দিয়ে টেনে এনে সেই বরফের টুকরাকে গলিয়ে ব্যবহার করে। দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ মালয়েশিয়া থেকে পাইপ-যোগে পানি আনে পানির অভাব মেটাতে। এছাড়াও সিঙ্গাপুরে বৃষ্টির এক ফোঁটা পানিও সমুদ্রে গড়াতে দেয়া হয় না। এক ফোঁটা সুয়্যারেজ এর পানিও সমুদ্রে যায় না; সেখানে বড় বড় রিজার্ভার আছে; সেসব বৃষ্টি ও সুয়্যারেজের পরিশোধনকৃত পানি মজুত রাখা হয়। সিঙ্গাপুরে বড় একটি নদীর পানিকে শোধন করে সুপেয় পানিতে পরিণত করে মানুষের খাবার ও অন্যান্য প্রাত্যহিক কাজে পানির অভাব মেটানো হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ মিঠা পানিতে পূর্ণ। সিঙ্গাপুরের মত ব্যয়বহুল ও কষ্ঠসাধ্য কোন প্রকল্প আমাদের নিতে হয় না। এরপরও আমরা নিরাপদ পানির অভাবে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি। মিঠা মানির সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারী উদ্যোগেরও বিকল্প নেই।
পানির বিষয়ে আমাদের অত্যধিক সচেতনতা প্রয়োজন।
১. বিশুদ্ধ পানির উৎস নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহন ও বাস্তবায়ন।
২. বৃষ্টির পানি সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার
৩. বিল্ডিং নির্মাণ নীতিমালায় প্রতিটি বিল্ডিংএ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণপূর্বক পানি পুনরায় ব্যবহারকল্পে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো।
৪. পানির অপচয় রোধ ও পানি ব্যবহারে সংযমী হওয়া।
৫. শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসমূহে পানি বিষয়ে পড়ানো ও গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ নিশ্চিত করা।
উন্নত সভ্যতার অনন্য একটি দিক হচ্ছে সঠিক সুয়্যারেজ ব্যবস্থা। ডঐঙ এর মতে- প্রতি বছর ১.৬ মিলিয়ন মৃত্যুর কারণ হল অনিরাপদ পানি এবং দূষিত পরিবেশ ও ভালো পয়োপ্রনালীর অভাব। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন টাকা খরচ হচ্ছে পানিবাহিত রোগের চিকিৎসার জন্য। স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা বিশেষত স্যানিটেশন বর্জ্যরে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগের হার প্রায় শূন্যের কোঠায় উপনীত করার এক বিরল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ সৃষ্টি করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হলেও পয়োবর্জ্যের অপসারণ ও সম্পদে রূপান্তরের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে না পারলে পরিবেশ দূষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি থেকেই যাবে। আমাদের সুয়্যারেজ ব্যবস্থা টেকসই না হওয়াতে অধিকাংশই নদী ও খালকে দূষণ করছে প্রতিনিয়ত। কিছু ক্ষেত্রে সুয়্যারেজের লাইনের সাথে পানির লাইন এক হয়ে দূষণ ছড়াচ্ছে। বস্তি ও প্রান্তিক বহু এলাকায় সুয়্যারেজ এর চরম ঘাটতি ও পানির অপ্রাপ্যতা সমস্যা বিদ্যমান। দেশের সকল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত পয়োনিষ্কাশন ও নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি ৬) অর্জনের জন্য। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষত দুর্গম উপকূলীয় অঞ্চল, চর, হাওর, পাহাড়ি এলাকা, শহরের বস্তিবাসী, দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ নিম্ন আয়ের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীদের প্রতি বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে চাহিদা অনুযায়ী দ্রুতগতিতে সবাইকে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের আওতায় আনতে হবে। ২০৩০ এর মধ্যে এসডিজি অর্জনের কঠিন পথ পাড়ি দিতে নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনের গুণ ও পরিমাণগত মান নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন বলতে প্রতিটি পরিবারে আলাদা টয়লেট থাকার কথা বলা হয়েছে এসডিজিতে। অত্যধিক শেয়ারড ল্যাট্রিনের বিষয়টি মোটেও নিরাপদ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে-মেয়েদের আলাদা টয়লেট করার দিকটি বিবেচনায় নিতে হবে। ওয়াসার পানির গুনগত মান নিশ্চিতকরণ ও পাইপ নেটওয়ার্ক খতিয়ে দেখা জরুরী। চারটি সিটি কর্পোরেশনে এলাকার মহানগরীর বিশাল জনগোষ্ঠীকে পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন এবং ড্রেনেজ সেবা প্রদানে ওয়াসা’র সীমিত সম্পদ ও প্রযুক্তি সত্তে¡ও অদম্য প্রচেষ্ঠা চলমান। এতদসত্তে¡ও আরো মনিটরিং পূর্বক সকলের জন্য নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিতে ওয়াসাকে প্রাগ্রসর ভূমিকা রাখতে হবে। নিরাপদ পানি, পয়োনিষ্কাশন খাতে অর্থায়ন ঘাটতি কমিয়ে আনাও জরুরী। এক্ষেত্রে ওয়াসার রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির প্রতি জোর দেয়া দরকার। নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশনকে একটি পৃথক খাত হিসেবে জাতীয় বাজেটে পৃথক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। সর্বোপরি পরিবেশবান্ধব, টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্যসম্মত পায়োনিষ্কাশনের জন্য সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কাউকে বাদ দিয়ে বা পিছিয়ে রেখে এসডিজি অর্জন সম্ভব নয়। স্বাস্থ্যসম্মত জাতি গঠনে গুণগত মানসম্পন্ন নিরাপদ পানি ও পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিতে সকলের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা আবশ্যক।
লেখক : সভাপতি, এসডিজি ইয়ুথ ফোরাম।
তথ্যসূত্র ঃ
(১) উন্নয়ন পদক্ষেপ ঃ পঞ্চম বর্ষ, ষষ্ঠদশ সংখ্যা
(২) বাংলাদেশ আর্সেনিক চিত্র ২০০০ : কামরুল ইসলাম চৌধুরী সম্পাদিত।
(৩) হালখাতা, ডিসেম্বর ২০১১ (নিরাপদ খাবার পানি সংকট ঃ প্রেক্ষিত বাংলাদেশ সংখ্যা)
(৪) দৈনিক প্রথম আলো ৬ মে ২০১৯
(লেখাটি আজ ওয়াসা চট্টগ্রাম কনফারেন্স হলে এসডিজি ইয়ুথ ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে কী নোট হিসাবে উপস্থাপন করা হবে।)