সংগ্রামী জননেতা জহুর আহমদ চৌধুরী

109

বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রণী সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধা চলাকালীন সমগ্র দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান বেসামরিক প্রশাসক, শ্রমিক আন্দোলনের অগ্রদূত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা, অন্যায় অবিচার অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী নায়ক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রীসভার শ্রম ও সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী একটি নাম, একটি আদর্শিক স্মরনীয় প্রতীক। বাঙালির ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যাঁর অবস্থান তাঁকে স্মরণ না করলে অকৃতজ্ঞ হবে বাঙালি জাতি। যাঁর সংগ্রামী জীবন ছাড়া অপূর্ণ হবে বাঙালির ইতিহাস। ফার্সী ভাষার একটি প্রবাদ ‘ কদরে নেয়ামত বাদে যাওয়াল’ নেয়ামতের কদর বৃদ্ধি হয় হারানোর পরই। আমাদের জাতিগত চরিত্র হলো বেঁচে থাকতে আমরা গুণীর সম্মান ও প্রশংসা করিনা। মৃত্যুর পরই মানুষের গুণের কথা স্মরণে আসে। জহুর আহমদ চৌধুরীর মত একজন কর্মযোগী অসম্প্রদায়িক উদার মানবপ্রেমিক মানুষকে আমরা মৃত্যুর পরও যথাযথ মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে পারিনি।
মানুষ বেঁচে থাকে বয়সে নয় কর্মে। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, জীবনটাকে লম্বায় বড় করা যায় না, পরিধিতে বাড়াতে চেষ্টা করুন’। আল্লাহ পাকের নিকট হতে জহুর আহমদ চৌধুরী যতটুকু হায়াতে জিন্দেগী এনেছেন তার চেয়ে একটুও বৃদ্ধি করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর কর্ম সাধনায়, সংগ্রাম আর আদর্শে জীবন পরিধি বৃদ্ধি করেছিল অনেক অনেক বেশি।
নিপীড়িত নিষ্পেষিত জনগণের মুক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ জননেতা জহুর আমদ চৌধুরী ১৯১৫ সালে চট্টগ্রামস্থ কাট্টলীতে জন্মগ্রহণ করেন। রেলওয়ে হাইস্কুলে পড়াশোনার পর রাজনীতির টানে কলকাতায় গিয়ে মুসলিম লীগে জড়িয়ে পড়েন। সেখানে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সহরোওয়ার্দী সাথে প্রবল ঘনিষ্ট হয়ে উঠে। সান্নিধ্য অর্জন করেন সর্বভারতীয় শ্রমিক নেতা পরবর্তীকালে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভি ভি গিরি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, আচার্য প্রফুল্লা চন্দ্ররায়, মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও জওহর লাল নেহেরুর সাথে। কলকাতায় থাকতেই ১৯৪৩ সালে প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয়। শুরু হয় তাঁর সংগ্রামী জীবন। ৪৪ সালে খিদিরপুর ডকে জাহাজ শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে তাদের সংগঠিত করেন। ৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সাথে ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি নারায়নগঞ্জে এসে জাহাজী শ্রমিক ইউনিয়ণ গড়ে তোলেন এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। নারায়নগঞ্জ হতে জন্মস্থান চট্টগ্রামে ফিরে ঘোড়ার গাড়ী মালিকদের সংগঠন গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণী কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন পূর্ববাংলার বিরুদ্ধে শোষন চক্রান্ত করে তখন তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। ১৯৫০ সালে মরহুম এম এ আজিজ ও তাঁর যৌথ নেতৃত্বে বৃহত্তর চট্টগ্রামে আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠন প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৫১ সালে খাদ্য আন্দোলন, ৫২ সালে ভাষা আন্দোল ’৫৩ সালে বাঙালি পুলিশের বেতন বৃদ্ধি আন্দোলন করতে গিয়ে বার বার তিনি কারাবরণ করেন। ’৫৪ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী রিয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকীকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী জহুর আহমদ চৌধুরী বিপুল ভোটে পরাজিত করে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট সরকার অপসারণ হলে ৯২(গ) ধারা জারি করে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে। কারাগারে বহু রোগের আক্রান্তে শারিরীক ক্ষতি সাধিত হয়। জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতনে ও আর্থিক অভাব অনটনে ন্যায় নীতি থেকে কখনো তিনি বিচ্যুত হননি। ১৯৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর সংগ্রাম ছিল কুলি মুজুর শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠার। যেখানেই নিম্ন শ্রেণীর মানুষের অধিকার খর্ব হত সেখানেই তিনি বিদ্রোহে জেগে উঠতেন। তিনি নিজে শ্রমিকদের সাথে মিশে যেতে পারতেন এবং শ্রমিক প্রতিনিধি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। তাই তিনি চট্টগ্রামের একজন শীর্ষ নেতা হয়েও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন গঠন করেন এবং নেতৃত্ব দেন। তিনি যে সকল শ্রমিক সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন নিম্নে তার নাম উল্লেখ করা হলো : (১) কর্ণফুলি পেপার মিল শ্রমিক ইউনিয়ন (২) কর্ণফুলি রেয়ন শ্রমিক ইউনিয়ন (৩) চট্টগ্রাম ডক (৪) বাংলাদেশ টোবাকো (৫) আমিন টেক্সটাইল মিল (৬) দাউদ জুট মিল (৭) আমিন জুট মিল (৮) ভিক্টোরিয়া জুট প্রোডাক্ট (৯) চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ শ্রমিক ইউনিয়ন (১০) কালুরঘাট ইস্পাহানী জুট মিলস (১১) বার্মা ইস্টার্ণ (বিওসি) (১২) চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট কর্মচারী ইউনিয়ন (১৩) টাটারী গ্লাস শ্রমিক ইউনিয়ন (১৪) পাকবে নারায়নগঞ্জ (১৫) আজিজ উদ্দিন ইন্ড্রাস্ট্রিজ (১৬) বেঙ্গল বেল্টিং শ্রমিক ইউনিয়ন।
জহুর আহমদ চৌধুরী পাকিস্তানী শাসক শোষক শ্রেণি প্রলোভন ও রক্তচক্ষুকে উপক্ষো করে এদেশের নিষ্পেষিত কর্মী জনতার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লালদীঘির ময়দানে তাঁর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সভায় বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করেন। সে মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক হিসেবে পল্টনের জনসভায় বক্তব্য রাখার পর তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কারাগারে নির্যাতনে তাঁর শ্রবণ হ্রাস পায়। ’৬৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাতিলের দাবীতে আন্দোলন করেন। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনগণকে তিনি সংগঠিত করে ’৭০ সালে বিপুল ভোটে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ’৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে চট্টগ্রামে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু ৩২ নং বাড়ি থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার বাণী প্রেরণ করে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। বঙ্গবন্ধুর বাণীটি সে রাতেই তিনি চট্টগ্রামে এক জাহাজের মাধ্যমে বেতারযোগে বিশ্বের দরবারে প্রচার করে গৌরব অর্জন করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাণীটির অনুলিপি চট্টগ্রাম শহরে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরীর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। জনাব চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চল লিবারেশন জোনে এবং পরে দক্ষিণ-পূর্ব প্রশাসনিক কাউন্সিল-২ এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
সাবেক মন্ত্রী এক সময়ের প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক চৌধুরী শোষিতদের স্বার্থে আর শোষকের বিরুদ্ধে শুধু সংগ্রাম করতেই যেন এ দুনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম থেকে আরম্ভ করে দেশ গড়ার সংগ্রাম পর্যন্ত এর প্রত্যেকটিতেই তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে গৌরবোজ্জল ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অবিশ্রাম ঝড়ো সফর ও অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দেশবাসী অবাক বিষ্ময়ে দেখেছে এই ভগ্ন স্বাস্থ্য দেশের মধ্যে কেমন তেজোদ্দীপ্ত প্রাণ ছিল।… যুদ্ধ চলাকালীন একবার তিনি কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বাণী ও প্রথম আমার হাতে এসেছিল মুক্ত বাংলায় বিজয় পতাকাও সর্বাগ্রে আমি উঠাব। সে দিন অনেকের কথাটি বিশ্বাস হয়নি বলে সহাস্যে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা সত্যে পরিণত হয়েছিল। ষোলই ডিসেম্বর তিনিই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উড়ান মুক্ত বাংলার বুকে (সূত্র : পাক্ষিক মিতালী, ৯ আগস্ট ১৯৭৪)।
জহুর আহমদ চৌধুরী ছিলেন মেধা ও প্রজ্ঞাবান নেতা। পড়াশোনায় তাঁর দক্ষতা ছিল প্রচুর। পৃথিবীর বিখ্যাত গ্রন্থ সংগ্রহ করে পড়েছেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন সমগ্র দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব পালন কালে আগরতলার অফিসে বসে ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ নিজেই ইংরেজিতে লিখতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিহারে রেজিমেন্টের মেজর জেনারেল শর্মা দক্ষিণ-পূর্বঞ্চলের ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ গুলি দেখে বিষ্মিত হয়ে বলেন, একজন রাজনীতিক কিভাবে সুন্দর নির্ভুল ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ গুলি লিখলেন ? সামরিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া কারও পক্ষে এ ধরণের ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ লেখা সম্ভব নয়। এ ধরনের ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ লেখা কিভাবে সম্ভব হলো শর্মা বাবু জানতে চাইলে জহুর আহমমদ চৌধুরী জানালেন, ১ম বিশ্বযুদ্ধ হতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পৃথিবীতে বড় বড় যত যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তার সব ডধৎ জবঢ়ড়ৎঃ সংগ্রহ করে আমি অত্মস্থ করেছি। জেনারেল শর্মা আগরতলা অফিস হতে বেরিয়ে যাওয়ার সময় শ্রদ্ধায় সেল্যুট করে বলেছিলেন, আপনি আমার গুরু আমি আপনার শিষ্য। এই ছিল জহুর আহমদ চৌধুরীর মেধা ও প্রজ্ঞার পরিচয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সোনার মানুষ হিসেবে জহুর আহমদ চৌধুরী প্রথম মন্ত্রী পরিষদের শ্রম ও সমাজ কল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রীর যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ’৭৩ সালের ৭ মার্চ সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে আবারও মন্ত্রী সভার সদস্য হন। ’৭৪ সালের জুন মাসে নিও ব্রংকাইটিসে আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৮ ও ৩০ জুন বঙ্গবন্ধু তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যান। ‘৭৪ সালের ১ জুলাই সকাল ৬ টা ৪৫ মিঃ সময় বাঙালি জাতির নন্দিত নেতা ঢাকায় পিজি হাসপাতালের ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করে চলে যান। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গভীর শোকে বলেছিলেন ‘ সুদীর্ঘ জীবনের সুখ-দুঃখের সাথীকে হারিয়ে আমি আজ এতিম হয়ে গেলাম। তিনি জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রস্তাবের ভাষণে সুদীর্ঘ ৩১ বছরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধু যে কবিতার পংক্তি উচ্চারণ করেছিলেন তা উদ্ধৃতি করে এবং জহুর আহমদ চৌধুরীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখার ইতিটানছি।
‘কাঁদিবনা আর আমি
কাঁদিবনা আর
আমার দুঃখের দিন
রহিবেনা চিরদিন।
দুই দিন কেন তবে
কেঁদে অবসান হবে,
দুঃখেও হাসিব আমি
লীলা বিধাতার
কাঁদিবনা আর আমি, কাদিবনা আর।’

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক