সংক্রমণ ঠেকানোর সুযোগ কতটা কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ?

45

চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল জানুয়ারি মাসের গোড়াতে, আর তখন থেকেই আশংকা করা হচ্ছিল যে- নতুন এই ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনের উহান শহরকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সরকার। পরে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় হুবেই প্রদেশেও।
চীনে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা শ্লথ হওয়ার পর সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে ইরানে। এরপর ব্যাপক সংক্রমণ আর মৃত্যুর খবর আসতে থাকে ইতালি থেকে। এ পর্যন্ত বিশ্বের ১১৭টি দেশের মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
বাংলাদেশে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১০ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বা আইইডিসিআর। তবে প্রশ্ন উঠছে যে করোনাভাইরাসের মতো একটি জীবানু ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে শুরু থেকে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুতি ছিল?
চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে যাবার পরে প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছে বাংলাদেশ নিজেকে প্রস্তুত করে নিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন ব্যবস্থা বাংলাদেশ শুরু থেকেই নিতে পারতো। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন যে বাংলাদেশে বিষয়টিকে প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশ সরকার জোরদার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে কোনো পরিকল্পনার ছাপ নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ের একজন বিশেষজ্ঞ মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে বাংলাদেশের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনা ছিল না। তবে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা করতেও অনেকটা সময় ব্যয় হয়েছে। তিনি বলেন, ‘যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয় সেগুলো অ্যাডহক, যখন যেটা মনে হয়েছে দরকার, তখন সেটা নেয়া হয়েছে। যেমন আমাদের ল্যাবরেটরি প্রস্তুতি কিছুটা ছিল, কিন্তু পুরোপুরি ছিল না’।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের মতো জীবানু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য যেসব উপাদান দরকার, বাংলাদশে সেগুলো পর্যাপ্ত নেই। এটার আগাম অর্ডার দিতে হয় এবং বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আনতে হয়। করোনাভাইরাসের বিস্তার কতটা হয়েছে তা বোঝার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যাপকভিত্তিতে পরীক্ষা করা হলেও বাংলাদেশে সে ব্যবস্থাই নেই। আমাদের রোগী হাসপাতালে আসলে কোথায় রাখবো, কিভাবে রাখবো, হাসপাতালে রোগীরা কিভাবে ঢুকবে- এখনো সে প্রস্তুতিটা ভালোভাবে করতে পারি নাই।
তাছাড়া যেসব চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিবে, তাদের সুরক্ষার জন্য কোন ধরণের সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে সেটিও ঠিকমতো নিশ্চিত করা হয়নি বলে মনে করেন মাহমুদুর রহমান।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যখন বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের আগমনের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে, তখনও বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ দৃশ্যমানভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। একটির পর একটি দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিলেও শুরু থেকে বাংলাদেশে বিষয়টিতে কোনো নজর দেয়নি বলে উল্লেখ করেন বিশেষজ্ঞেরা।
তাছাড়া বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে পর্যবেক্ষণ কিংবা স্ক্রিনিং করার বিষয়টিও শুরু থেকে যথাযথ হয়নি। বিমানবন্দরে যাত্রীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয় থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে, অর্থাৎ দেখা হয় যে একজন যাত্রীর জ্বর আছে কি না।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে- এসব থার্মাল স্ক্যানারের বেশিরভাগই ছিল অকার্যকর। বিশেষজ্ঞরা মন করেন, বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনের কথা বলে দায়িত্ব সেরেছে কর্তৃপক্ষ। এসব মানুষ আসলেই বাড়িতে থাকছে কিনা, সেটিও ঠিক মতো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানোর জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন, তাদের সবাইকে খুঁজে বের করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে জনগণের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কিনা, তা নির্ণয় করার কোনো ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশে নেই। তিনি প্রশ্ন তোলেন, কিসের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে যে বাংলাদেশের কমিউনিটিতে এখনো করোনাভাইরাস ছড়ায়নি?
তবে আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর দাবি করেন, চীনে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চীনের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর সঙ্গে বাংলাদেশের আইইডিসিআর-এর যোগাযোগ রয়েছে। আমরা ওখান থেকেও খবর পাচ্ছিলাম যে উহানে আননোন (অজানা) নিউমোনিয়া হচ্ছে। এবং সেটা সম্ভবত সার্স কিংবা মার্স হতে পারে। ৩১ ডিসেম্বর ওরা ডব্লিউএইচও’কে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) জানানোর পর থেকেই আমাদের প্রস্তুতি শুরু। এরপর থেকেই চীন থেকে আগত যাত্রীদের ক্ষেত্রে বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। খবর বিবিসি বাংলার
অবশ্য এমন জোরালো অভিযোগ রয়েছে যে- বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কার্যক্রমটি মোটেও কার্যকরী ছিল না। অনেক যাত্রী কোনো ধরণের পর্যবেক্ষণ ছাড়াই বিমানবন্দর দিয়ে দেশে প্রবেশ করে বলে জানা গেছে।