শয়ন সাথে রওনা তুমি নয়ন পাতে রও

223

বসন্তে জয় হোক ভালোবাসার। মানব মনের যৌবন ও প্রকৃতির বসন্তকাল একাকার হয়ে ওঠে ফাল্গুন-চৈত্রে। মধ্যযুগের পন্ডিত কবি আলাওল ও তার পদ্মাবতী কাব্যে বলেন :
‘প্রেম বিনে ভাব নাহি ভাব বিনে রস
ত্রিভুবনে যত দেখ প্রেম হন্তেÍ বশ’। (আলাওল)
প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবী অচল হয়ে পড়বে। নারীতে-পুরুষে, মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ভালোবাসার বন্ধনকে অবলম্বন করে পৃথিবী টিকে আছে। প্রেম-ভালোবাসা মানুষে সহজাত প্রবৃত্তি। আদিকাল থেকে ভালোবাসার নদী বহমান। এ জন্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অনন্তপ্রেম’ কবিতায় বলেন :
‘আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি
মগল প্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে।
আমরা দু’জন করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহ বিধুর নয়ন সলিলে, মিলন মধুর লাজে
পুরাতন প্রেম নিত্য নতুন সাজে।
প্রেমিক কবি প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন :
‘আজি সেই চির দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে।’ কবি যথার্থই বুঝতে পেরেছেন :
‘নিখিলের সুখ, নিখিলের দুখ, নিখিল প্রাণের প্রীতি,
একটি প্রেমের মাজারে মিশেছে সকল প্রেমে স্মৃতি-
সকল কালের সকল কবির গীতি। রবীন্দ্রনাথ নিখিল বিশ্বের শাশ্বত প্রেমের ঠাকুর। তাঁর প্রেম চেতনা আদর্শ ও আধ্যাত্মিকতায় উজ্জীবিত।
বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্যে জাগতিক প্রেম-বিরহের শ্রেষ্ঠ কবি। প্রেম সম্পর্কে তার ধারণা :
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমনী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
নজরুলের প্রেমে দর্শনের গভীরতা আরো ব্যাপক। প্রেমিক কবি বলেন :
‘যে কেহ প্রিয়ারে তার চুম্বিয়াছে ঘুম ভাঙা রাতে,
রাত্রি জাগা তন্দ্রা লাগা ঘুম পাওয়া প্রাতে,
সকলের সাথে আমি চুমিয়াছি তোমা
সকলের ঠোঁটে যেন হে নিখিল প্রিয়া প্রিয়তমা।’
নজরুল বাংলাকাব্যে জীবন ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রীয় প্রেমের প্রবর্তক। যাকে পাননি তার জন্যেই কবির ভালোবাসা উপচে পড়ে : ‘গোপন প্রিয়া‘ কবিতায় :
‘পাইনি বলে আজো তোমায় বাসছি ভালো রানি,
মধ্যে সাগর এপার ওপার করছে কানা কানি।…
থাকবে তুমি ছায়ার সাথে
মায়ার মতো চাঁদনী রাতে
যত গোপন তত মধুর নাই বা কথা কও।
শয়ন সাথে রওনা তুমি নয়ন পাতে রও।’- প্রেমিক কবি প্রিয়তমাকে না পেয়ে বলেন : ‘প্রিয়া হয়ে এলে প্রেমে,
বধূ হয়ে এলে না অধরে।’
এমনি অবস্থায় কবির সিদ্ধান্ত :
‘প্রেম এক, প্রেমিকা সে বহু,
বহু পাত্রে ঢেলে পিব সেই প্রেম
সে শরাব-লোহু।
তোমারে করিব পান, অ-নামিকা, শত কামনায়
ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়।’
ব্যক্তি প্রেমের এমন প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে ইতিপূর্বে কোন কবির কাব্যে দেখা যায় নি। তিরিশোত্তর আধুনিক কবিরা এ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের কাছে ঋণী।
বাংলাসাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি শাখায় প্রেম-ভালোবাসা প্রধান বিষয়। আধুনিক যুগে ভালোবাসার মূল্যবোধে পরিবর্তন এসেছে। চিরন্তন শাশ্বত প্রেমের ঐতিহ্য বর্তমানে খুবই দুর্লভ। রাধা-কৃষ্ণ, লায়লী-মজনু, শিরিন-ফরহাদ, পদ্মাবতী-রত্নসেন ইত্যাদি বিশ্ববিশ্রুত প্রেমের ঐতিহ্যচর্চা এখন নেই বললেই চলে। আমরা বিশ্বায়নের ফলে যতটা যান্ত্রিক হচ্ছি ততটাই আমরা হৃদয়বৃত্তিতে দুর্বল হয়ে পড়ছি। তাই ইদানীং পাশ্চাত্যে-প্রাচ্যে Valentine’s Day ভালোবাসা দিবস ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্টন ভ্যালেইটাইন’স নামে একজন খ্রিস্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচার অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় র্কাডিয়াস তাঁকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষিত দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এতে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যুদÐ দেন। সে দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল। অতপর ৪৯৬ সালে পোপ সেন্ট জেলাসিউও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। বিভিন্ন সময় এ দিবস ইউরোপে নিষিদ্ধও হয়। আর বর্তমানে যান্ত্রিক সভ্যতার কৃত্রিমতার প্রেক্ষাপটে দেশে-বিদেশে এ দিবস ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশকেও এর ঢেউ ছোঁয়ে যাচ্ছে বছর বছর।
‘সেই বুঝি বুঝিলে রাজন
একা সে সুন্দর হয় হইলে দু’জন।’
জয় হোক ভালোবাসার, জয় হোক সকল প্রেমিকের।
‘পিরিতি নগরে বসতি করিব
পিরিতে বাঁধিব ঘর
পিরিতি দেখিয়া পড়শি করিব
তা বিনু সকলি পর।’ (চন্ডীদাস)
আমাদের বাংলা সাহিত্যে চন্ডীদাস এক অসাধারণ প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি। রজকিনী-চন্ডীদাস প্রেমকাহিনী বহুল জনশ্রুতি। মধ্যযুগের বাংলাকাব্যে চন্ডীদাস খাঁটি বাঙালি কবি এবং সহজ ভাষায় গভীর ভাব প্রকাশের কবি। তাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেন- ‘তিনি (চন্ডীদাস) একছত্র লিখেন দশছত্র পাঠক দ্বারা লিখাইয়া লন।’ এই চন্ডীদাস প্রেমকে জীবনের সর্বস্ব মনে করতেন। চন্ডীদাসের ইচ্ছা ছিল একটা প্রেমময় পৃথিবী গড়া।