শ্রীশ্রী ব্রজেন্দ্র সাধু বাবাজী

213

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার সবুজ-শ্যামল শোভামন্ডিত নীরব নিবৃত্তপল্লী এনায়েতপুর গ্রাম। উক্ত গ্রামের জনৈক চন্দ্রকুমার চৌধুরীর সাধ্বীপত্নী জানকী বালা চৌধুরীর কোল আলোকিত করে বাংলা ১৩১৫ সালের ২০ আষাঢ় শুভক্ষণে এক দেবশিশুর আবির্ভাব ঘটে। শুভদিনে শিশুর নামকরণ করলেন ‘শ্রী ব্রজেন্দ্র কুমার’। দিনে দিনে শিশু ব্রজেন্দ্র বড় হতে থাকে। সময়মত তাঁকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অতি প্রখর, যেকোন কথা একবার শুনলেই মনে গেঁথে যেতো। বয়স যত বাড়তে থাকে ব্রজেন্দ্র ততই অন্যমনস্ক হয়ে যেতে লাগল। মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হঠাৎ করে কিশোর ব্রজেন্দ্রের কথাবার্তা, চালচলনে কেমন জানি অসংলগ্নতা দেখা দেয়। ছেলের এই অস্বাভাবিক আচরণ দেখে পিতা চন্দ্রকুমার বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি ছেলেকে নিয়ে ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম শহরের প্রসিদ্ধ যোগপীঠ শ্রীশ্রীপঞ্চানন ধামে। সেখানে তিনি সাধকপুরুষ যোগানন্দ শ্রীশ্রী নগেন্দ্রনাথ চৌধুরীর নিকট শরণাপন্ন হন এবং উনাকে পুত্র ব্রজেন্দ্রের বিষয়ে অবহিত করলেন। ত্রিকালজ্ঞপুরুষ ‘শ্রীশ্রী নগেন্দ্রনাথ’ যোগাস্থিত হয়ে ব্রজেন্দ্রকুমারের ভূতভবিষ্যৎ জ্ঞাত হলেন, অতঃপর তাঁকে দীক্ষা প্রদান করে বললেন এই ছেলে কোন সাধারণ কেউ নন। তাঁর ভিতর যে আত্মজ্ঞান লাভের অসীমতা বিদ্যমান স্বয়ং গুরুদেব তা প্রকাশ্য স্বীকার করলেন। গুরুধাম থেকে বাড়ী এসে শ্রী ব্রজেন্দ্রকুমারের আচার-আচরণে বেশ পরিবর্তন দেখা গেল। আপন খেয়ালখুশি মত তিনি বিভিন্ন আশ্রম, মঠ-মন্দির, মাজার এসব নানাস্থানে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অহর্নিশি আর বিড়বিড় করে সর্বদা কিছু যেন বলতেছেন। ধীরে ধীরে কৈশোর অতিবাহিত করে যৌবনে পা রাখেন তিনি। এরই মধ্যে সবার অগোচরে ১৯৩২ সালে গুরুদেবের নির্দেশে সত্যানুসন্ধান অর্থাৎ ঈশ্বর লাভের তরে যুবক ব্রজেন্দ্র একদিন সুদূর বার্মায় (বর্তমান মায়ানমার) গমন করেন। পরিচিত কারো সাক্ষাত হলে বলতেন জীবিকার তাগিদে এসেছেন তিনি। উল্লেখ্য, তাঁর এই জীবিকা যে সেই জীবিকা নয়। এযেন অন্তরের ক্ষুধা নিবৃত্তির জীবিকা। ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের জীবিকা। সেখানেও তিনি বিভিন্ন মঠে-মন্দিরে, সাধনপীঠ পরিভ্রমণ করতে থাকেন অবিরাম ভাবে। মূলত ঈশ্বরতত্ত¡ জানার তরে তাঁর মায়ানমার গমন। স্বীয় গুরুর আদেশ পালন তরে মায়ানমারে দীর্ঘ দশ বছর অতিক্রম শেষে, বহু অলৌকিক শক্তির অধিকারী ‘সাধক ব্রজেন্দ্রকুমার’ স্বদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তিনি এক ভিন্নরূপ ধারণ করলেন যেন তাঁর সাধনকর্মে কেউ বিঘœ না ঘটায়। সুস্থ, সবল, সুঠাম ও তেজস্বী পুরুষ ‘সাধক ব্রজেন্দ্র’ কখনো শান্ত, কখনো গম্ভীর, কখনো ভীষণ তর্জন-গর্জন, কখনো অট্টহাসি ইত্যাদি নানাবেশে ছুটোছুটি করতে থাকেন সর্বত্র। অতি অল্পদিনে তিনি ‘ব্রজেন্দ্র পাগলা’ নামে পরিচিতি হলেন এলাকার সবার কাছে। ইতিমধ্যে পার্শ্ববর্তী ছাদেকনগর গ্রামের আধ্যাত্মিক সাধক শাহছুপি হযরত আবদুল জলিল শাহ প্রকাশ বালুশাহ’র সাথে সুনিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে শ্রীশ্রী ব্রজেন্দ্র বাবাজীর। তাঁরা দু’জনই একান্তে গভীর সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন বেশিরভাগ সময় নির্জন স্থানে। যাহা অত্র এলাকায় ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়াও সাধুবাবা স্বীয় গুরুধাম তথা পঞ্চাননধাম, তুলসীধাম, সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ ধাম, চন্ডীতীর্থ মেধসাশ্রম, শ্রীশ্রী পুন্ডরীক ধাম, ফতেয়াবাদ ব্রহ্মানন্দ যোগাশ্রম, সুয়াবিল সিদ্ধাশ্রম মঠ, মন্দাকিনী শিবমন্দির, মির্জাপুর শান্তিধাম বিহারে বৌদ্ধদের অষ্টম সংঘরাজ শীলালংকার মহাথের, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, হযরত শেরেবাংলা শাহ, হযরত শাহজাহান শাহ মাজার, মাওলানা মতিউর রহমান শাহসহ অসংখ্য মহাত্মাদের সাথে সাক্ষাত ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অবাধ বিচরণ করতেন। এভাবে পাগলরূপী ব্রজেন্দ্র বাবার ঈশ্বর সাধনা চলতে থাকে দীর্ঘকাল যাবত গোপনে গোপনে। সাধারণত মহাপুরুষরা সহজে নিজেকে প্রকাশ করতে চায় না কোথাও। তেমনি ব্রজেন্দ্র সাধু বাবাজীও নিজেকে কখনো কারো নিকট ধরা দিতে চায় নি। কিন্তু অন্তর্যামীর ইশারায় সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এনায়েতপুরের আরেক সতীসাধ্বী রমণী প্রেমদা বালার নিকট বাবাজী নিজেকে প্রকাশিত করলেন স্ব-মহিমায়। একদিন প্রেমদা বালার উঠোন দিয়ে যাওয়ার পথে বাবাজী প্রেমদার অন্তরের কথা বলতে লাগলেন। তা শুনে প্রেমদা হতবাক ! একি, তিনি কিভাবে জানলেন আমার মনের কথা। তিনি যে, কোন সাধারণ পাগল নন প্রেমদার তখন বুঝতে বাকী রইল না। প্রেমদা পাগলরূপী ব্রজেন্দ্রকে চিনে ফেললেন এবং ভাবলেন এই পাগল বুঝি ভাবের পাগল, প্রেমের পাগল, অলৌকিক মহাপুরুষ। তখন থেকেই প্রেমদার গৃহে সাধুবাবা মাঝেমধ্যে যাওয়া আসা করতে লাগলেন। তাছাড়া আরো অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তিও বাবাজীর অলৌকিক অপূর্ব লীলা দেখে জীবন ধন্য করেছেন।
ভগবান গীতায় বলেছেন- ‘যোগযুক্ত ব্যক্তি সর্বত্রই সমদর্শী হন আর আমি সর্বভূতে বিরাজমান। যিনি সকলের মধ্যে আমাকে ও আমার মধ্যে সকলকে দেখেন এবং সুখে-দুঃখে সর্বজীবে সমদর্শী তিনিই যোগীশ্রেষ্ঠ।’ মহাযোগী শ্রীশ্রী ব্রজেন্দ্র সাধু বাবাজীও সেরূপ আত্মদর্শী যোগীপুরুষ নিঃসন্দেহে। তাইতো ভক্তদের আকুল আহবানে বাবাজীর হৃদয় আদ্র হয়ে উঠত। পরম দয়ালু সাধুবাবা ভক্তদের দুঃখ-কষ্টে ও সংকটময় মুহূর্তে সর্বদাই অযাচিত ভাবে ছুটে গিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতেন। সাধুবাবার অজস্র অলৌকিক লীলার মাত্র কয়টি চুম্বন অংশ আজ এখনে তুলে ধরলাম।
রাউজান উপজেলার গহিরা নিবাসী কনক বড়ুয়ার ছেলে রাষ্ট্রপাল বড়ুয়া পানিতে পড়ে মৃতপ্রায়। শোকাতুর স্বজনদের আর্তনাদে চারদিকের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সাধু বাবাজী অকস্মাৎ সেখানে উপস্থিত হয়ে বাঁচিয়ে তুললেন রাষ্ট্রপালকে। বর্তমানে রাষ্ট্রপাল বড়ুয়া আমেরিকা প্রবাসী। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাধুবাবা একদিন স্থানীয় সরকারহাট বাজারে হাঁটছেন। পাকসেনারা সাধুবাবাকে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে তাঁর বুকে পর পর তিন রাউন্ড গুলি করলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার, একটা গুলিও লাগেনি সাধুবাবার গায়ে। এই অবস্থা দেখে পাকসেনারা স্থানীয়দের থেকে জিজ্ঞেস করে জানলেন ইনি মুক্তিযোদ্ধা নন, একজন সাধক অর্থাৎ ‘ফকিরকা আদমি হ্যায়।’ তখন পাকসেনারা সাধুবাবার নিকট ক্ষমা চেয়ে প্রণাম করে বিদায় নেন। এছাড়াও সাধু বাবাজীর অসংখ্য অসংখ্য অলৌকিক লীলা কাহিনী রয়েছে যা চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে সবার মুখে মুখে।
মহাযোগী শ্রীশ্রী ব্রজেন্দ্র সাধুবাবা ঊনসত্তর বছর অবধি নানা প্রকার লীলা সম্পাদন করে ১৩৮৪ বাংলার ১৮ পৌষ মহাসমাধি যোগে পরমাত্মার সাথে মিশে গেলেন এবং রেখে গেলেন অজস্র কীর্তি প্রতিটি ভক্তের অন্তরে। বাবাজীর ৪১তম শুভ মহা-প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।