শ্রমজীবী শিশুর উন্নয়নে প্রয়োজন সবার আন্তরিক সহযোগিতা

201

সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে অধিকার সম্পর্কে ধারণার সৃষ্টি এবং অধিকার অর্জনের আকাক্সক্ষাকে সামনে রেখে প্রতি বছর বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় দেশে পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে নতুন জ্ঞান ও চেতনা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। শিশু অধিকার ফোরাম বেসরকারি উদ্যোগকে বলিষ্ঠ ও বেগবান করার লক্ষ্যে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ ঘোষণার সময়কাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে। বিগত তিন দশকে সরকারি উদ্যোগ যেমন প্রশংসিত হয়েছে, তেমনি বেসরকারি সংস্থার নিজস্ব কর্মসূচি ব্যাপকতা লাভ করেছে। শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে শিশুশ্রম দূর করার প্রচেষ্টা, নিবর্তনমূলক শ্রম বন্ধ করার পক্ষ্যে জনমত গড়ে তোলা, শিশুদের নিরাপদ পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করার গুরুত্ব প্রচার করা, অসহায় ও অবহেলিত শ্রেণির শিশুদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা, তাদের স্বাভাবিক মানবজীবন নিশ্চিত করতে সাহায্য করা, মেয়ে শিশুদের প্রতি অবহেলা ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে জাগরণ সৃষ্টি করা হয়েছে।


এত কিছুর পরও আমাদের ব্যর্থতার দায়ভার মোটের ওপর কম নয়, যা আমাদের ইতিপূর্বে অর্জিত অগ্রগতিকে ¤øান করে দিয়েছে। আমাদের শিশুরা স্কুলে যায়, পড়ালেখা করে। কিন্তু তাদের মতো, তাদের বয়সী অনেক বন্ধু আছে যারা স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও যেতে পারে না। তাদের মতো খেলাধুলা করার ইচ্ছে থাকলেও খেলতে পারে না। সে সুযোগ তাদের নেই। এরা কারা? এরা শ্রমজীবী শিশু। শ্রমজীবী হলো তারা যারা দৈহিক শ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে। যেমন শ্রমিক, মজুর,চাষা ইত্যাদি। তাদের মতো কিছু বন্ধুও কাজ করে বিভিন্ন জায়গায়। হোটেল রেস্তোরাঁয়, গণপরিবহনে, বাসাবাড়িতে, নানা ধরনের ওয়ার্কসপে, লেদ মেসিন কারখানায়, শিল্প কারখানায়, কাঁচা বাজারসহ শহর ও গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পেটের তাগিদে। এদের বলা হয় শ্রমজীবী শিশু।
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা বাড়ার পেছনেও একমাত্র কারণ আর্থিক অস্বচ্ছলতা। দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশ। ক্ষুদ্র আয়তনের এ দেশটিতে বাস করে ষোল কোটিরও বেশি মানুষ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশই শিশু। এ হিসেবে আমাদের দেশে শিশুর সংখ্যা ৬ কোটিরও বেশি। এ ছয় কোটি শিশুর মধ্যে বর্তমানে দেশে শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা ৭৪ লক্ষ। আর এর মধ্যে ১৩ লক্ষ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম কর্তৃক পরিবেশিত সর্বশেষ তথ্য জানা যায়, বাংলাদেশের গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রমজীবী শিশুরা সবচেয়ে বেশি বিপদাপন্ন। এদের শতকরা ৯৪ জন দিনের পুরো সময় কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত থাকে। সংস্থাটির মতে গৃহকর্মের শ্রমই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এরা সূর্যোদয় থেকে যে পরিশ্রম করে সে তুলনায় তাদের প্রাপ্তি খুবই নগণ্য।
আমরা এখন জানার চেষ্টা করব শ্রমজীবী শিশুদের উন্নয়নে রাষ্ট্র কী কী প্রয়াস নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে। এর আগে আমাদের জানা দরকার উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝি। একটি শিশু যেখানে কাজ করে সেখানে তার কাজ করার অনুকূল পরিবেশ আছে কি না? শিশুটিকে সঠিক বেতন বা মজুরি দেওয়া হচ্ছে কি না? অসুস্হ হলে শিশুটি ছুটি বা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে কি না? ক্লান্ত হলে সে বিশ্রামের সুবিধা পাচ্ছে কি না? কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদনের ব্যবস্থা আছে কি না? নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কাজ করানো হচ্ছে কি না? গৃহকর্মী হলে তার খাবার ও থাকার জায়গা স্বাস্থ্যমত কি না? আমাদের অনেকেরই জানা সরকার কতৃর্ক ইতিমধ্যে শিশু আইন ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইনে ৩৮ টি কাজকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে এ ৩৮টি কাজে শিশুদের কোনোভাবে নিয়োগ করা যাবে না। এ আইনের ফলে শ্রমজীবী শিশুদের কর্ম পরিবেশের উন্নয়নের জন্য মালিক, শিশু ও শিশুর অভিভাবকের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে শিশুর সামর্থ্য অনুযায়ী ঝুঁকিবিহীন কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কাজের ধরন, কাজের সুস্পষ্ট শর্ত, শিশুর পক্ষে অনুকূল কর্ম সংস্থানের পরিবেশ, শিক্ষা ও বিনোদন, চিকিৎসা সেবা, পরিবারের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ, শিশুর ভবিষ্যত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিশ্চিতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সচেতন মহল সচেষ্ট হয়েছে।
শ্রমজীবী শিশুদের নিয়োগকর্তাদের মন ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়ার বেলায় অবলম্বন করা হচ্ছে সতর্কতা। শ্রমজীবী শিশুদের কাজের পরিবেশ, কাজের ধরণ প্রভৃতি বিষয়ের উপর নজরদারি বেড়েছে। শিশু কিশোরদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ক্ষতি হয় এমন কাজে শিশুদের নিয়োগ করা থেকে বিরত রাখার যাবতীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অনুযায়ী সরকার ২০২১ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসন ও ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনে অঙ্গিকার করা হয়েছে। যে সব দরিদ্র অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজে পাঠাচ্ছে তা থেকে শিশুদের স্কুলগামী করতে বিনাবেতনে, বিনামূল্যে ও খাদ্যের বিনিময়ে শিক্ষা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এর ফলে অনেক অভিভাবক তাদের শিশুদের আবার স্কুলে ফিনিয়ে এনেছে। এতে করে অনেক পরিবারের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রমজীবী শিশুদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নে সরকারের গৃহীত উদ্যোগকে সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যম রাখতে পারে একটা বিরাট ভূমিকা। সামান্য রুজি রোজগারের জন্য শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে তাকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা যায় তা হবে মা বাবা ও শিশুটির ভবিষ্যতের জন্য উত্তম বিনিয়োগ। মা বাবার মধ্যে এ সচেতনতাবোধ জাগাতে গণমাধ্যম রাখতে পারে প্রশংসনীয় ভূমিকা।
একটি কথা জোর দিয়ে বলতে চাই শ্রমজীবী শিশুর উন্নয়নে রাষ্ট্র যতই আন্তরিক হোক না কেন তা কখনো সুফল বয়ে আনবে না। যদি শিশুর মা বাবা, অভিভাবক এবং শিশুদের যারা কাজে লাগায় সে নিয়োগকর্তারা সচেতন ও আন্তরিক না হোন। আমাদের ঘরে ফ্রিজ, টেলিভিশন, আসবাবপত্র রাখার জায়গা ঠিকই থাকে। শুধু জায়গা থাকে না যে মানুষটি যে শিশুটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে তার। এ মানসিকতার পরিবর্তন হলেই আমরা বিনির্মাণ করতে পারব শিশুদের জন্য শিশুশ্রমমুক্ত একটি সাজানো বাগান।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক