শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর

44

বাংলাদেশের সব্যসাচী ও মানবতাবাদী লেখক, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, চিন্তক, প্রগতিশীল সাহিত্যিক ও সংগঠক আহমদ ছফার ১৯তম মৃত্যু বার্ষিক ২৮ জুলাই। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তার মৃত্যু হয়। আমৃত্য তিনি সাহিত্যের নানান শাখায় লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারন প্রাধান্য পেয়েছে। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ জাতির শিক্ষক ও জাতির দর্পন হিসেবে আহমদ ছফাকে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের কন্ঠস্বর। গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী মিলিয়ে তার ৩০ টির ও অধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। নির্লোভ, নির্মোহ, নির্ভীক, লড়াকু ও পুরষ্কার বিদ্বেষী প্রখ্যাত এই চিন্তককে ২০০২ সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদকে (মরনোত্তর) ভূষিত করা হয়। এছাড়া ও লেখক শিবির পুরস্কার সহ আরো অনেকগুলো পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে।
বহু মাত্রিক মানবতাবাদী এ লেখক ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুরের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তার প্রথাবিরোধী, অকপট দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন। ৬০ এর দশকে তিনি কৃষক সমিতি ন্যাপ যা তৎকালীন গোপন কমিউিনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকান্ডে অনুপ্রানিত হয়ে সহ যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম-দোহাজারি রেললাইন উপরে ফেলেন। কিছুদিন আত্মগোপনের পর ১৯৬২ সালে নাজির হাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা ফেলোশিপ বৃত্তির জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘‘১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৭ খিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব”।
১৯৮৬ সালে আহমদ ছফা জার্মান ভাষার ওপর গ্যোটে ইনষ্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রী লাভ করেন। যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্য কর্ম “ফাউস্ট” অনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি লেখক সংগ্রাম শিবির গঠন করেন। সাতই মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা হিসাবে “প্রতিরোধ” প্রকাশ করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে “দাবানল”, পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
আহমদ ছফার প্রতিটি লেখাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে আহমদ ছফাকে সরকারের উচ্চ পদে বসানোর প্রস্তাব তিনি স্বাধীন চেতা মানসিকতার কারণে বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ মনজুরল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সেলিনা হোসেন, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকেই আহমদ ছফার জীবন ও রচনা কর্মে অনুপ্রাণিত ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন ‘‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্য কর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে, যে জগতে যে কোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে”।
আহমদ ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থে’র মধ্যে “জাগ্রত বাংলাদেশ”, “বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস”, ‘বাংলা ভাষা: “রাজনীতির আলোকে বাঙালি মুসলমানের মন”, “শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ”, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এছাড়া তিনি ভ্রমণ কাহিনি, কিশোরগল্প ও শিশুতোষ ছড়ার বই রচনা করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে উজ্জল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন আহমদ ছফা। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রæত পাঠকদের মনে সাড়া ফেলে দেন তিনি। আহমদ ছফার বেশ জনপ্রিয় একটি উপন্যাস ‘গাভী-বিত্তান্ত’। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রাজনীতি-দলাদলির স্বরূপ প্রকাশ পেয়েছে বইটিতে। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্নভাবে স্মরণ করেছেন। নিজেও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর “অলাত চক্র” উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন মর্মস্পর্ষী উপাখ্যান ও ভারতের শরনার্থী শিবিরের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। আহমদ ছফা সাহিত্যের নির্যাস নিয়েছিলেন বিশ্বকবির বীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে আর জ্ঞানের নির্যাস নিয়েছিলেন জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক থেকে। তাঁর রাজনৈতিক প্রবন্ধগুলো বাংলাদেশের সাহিত্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। তাঁর সাহসী কলমে এদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির নির্মম সত্যগুলো উঠে এসেছে। সত্তর দশকে ছফার খুঁজে পাওয়া সমস্যাগুলোর সাথে আজকের দিনের সমস্যা ও প্রাসঙ্গিকতা দারুণভাবে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখানেই আহমদ ছফার সাহিত্য ও দর্শন চিন্তার ভবিষ্যদ্বানী সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলা যায় তিনি বাংলা সাহিত্যের বাতিঘর। তাকে বুঝতে হলে তার রচনা পাঠ করতে হবে। তাকে বুঝতে পারলেই বোঝা যাবে বাঙালি জাতি সত্তার শিকড় ও সাহিত্যে রাজনৈতিক বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস।
২০০১ সালের ২৮ শে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আজ ২৮ জুলাই ২০ তম মৃত্যু দিনে চট্টল এই মনীষার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।