শোকাবহ আগস্ট

48

বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের গড়ে ওঠার সহস্র বছরের যে ইতিহাস, তার পূর্ণাঙ্গ রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্থপতি। আর বাংলাদেশের অপর নাম শেখ মুজিব। বাংলাদেশ নামের এই ভূখন্ডটি এই মহামানব আমাদের জন্য জয় করে এনেছেন তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের সীমাহীন ভালোবাসা, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা দিয়ে। আমরা আমাদের বাঙালি মনে করি। কারণ, আমরা বাংলায় কথা বলি। আমরা ধরে নিই, যেদিন থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে, সেদিন থেকেই বাংলা সংস্কৃতির সূচনা, বাঙালিত্বের পথচলা। কিন্তু ক্ষণজন্মা মুজিবের হাতেই এই বাঙালি পেয়েছে সত্যিকার রূপ, আর ঝলমলে পরিচয়টা।
বৃটিশ-বেনিয়ারা ভারতবর্ষ আর বাংলা দখল করার সাথে সাথেই বাঙালির জীবনে নেমে এল ঘোর অমানিশা। শুরু হল সাধারণ বাঙালিদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়ন। বৃটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতন যতই বেড়েছে, বাঙালিও তেমনি জাতীয়তাবাদী সত্তাকে জাগিয়ে তুলতে কঠিন ও কঠোর হয়েছে। বাঙালির নতুন মূল্যবোধের উন্মেষ হল।
পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃটিশরা এবার ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি গ্রহণ করল। তারা এখানকার
হিন্দু-মুসলমানদের একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করল। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করা হল ১৯০৫ সালে। তারপর দীর্ঘ ৪০ বছর চলল ষড়যন্ত্রের ও সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার রাজনীতি। হিন্দু-মুসলমানের রক্তে লাল হয়ে উঠল বাংলার মাটি। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ নেতা। অনাদিকালের ভ্রাতৃত্ব ও একতার মাধুর্যে গড়া বাংলার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা রোধে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করলেন। জওহরলাল নেহেরু, মহাত্মা গান্ধীসহ অনেকেই বাংলার বিভক্তি সমর্থন করলেন। বাংলার অনেক মুসলমান নেতা ও সংস্কৃতিসেবীদের বাধার মুখে শুধুমাত্র মুসলিম লীগের চাপে ১৯৪৭ সালে বাংলা ভিন্ন জাতিসত্তার অংশ হয়ে গেল। এই বিভক্তি এবং পাকিস্তানের সাথে বাংলার সংযোজন যে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার একটি নীলনক্শা তা বঙ্গবন্ধু বুঝে গেলেন। তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে সৃষ্টি হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোতে বাঙালি নির্যাতিত ও নিষ্পেষিতই হবে।
ভারত ভাগের পর শুরতেই পাকিস্তানি সরকার বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে রোধ করার চেষ্টা করল। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেয়া হলো উর্দুকে। বাঙালি চেতনা প্রবল হয়ে উঠল। আর এই জ্যোতিটা প্রজ্বালিত করলেন ইতিহাসের বরপুত্র অসীম সাহসী ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর বীরোচিত প্রতিবাদে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বেই তাঁর অদম্য নেতৃত্বে ভাষা দিবস পালিত হল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। বাল্যকাল ও কৈশোর থেকে তাঁর জীবনে যে সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তা কখনও থেমে থাকেনি। বরং বিস্তৃত হয়েছে কালের ধারাবাহিকতায়। এই মানুষটির ভেতরেই বিধাতা একটি জাতিকে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার সম্মোহনী শক্তি জুগিয়েছিলেন পরবর্তীতে। বঙ্গবন্ধু মুজিব তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষণ ব্যয় করেছেন বাংলার মানুষের অধিকার আদায় আর বাঙালিকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। তাই ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন ও ছাত্রলীগ গঠন থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘটনাবহুল আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে যেমন মহিমান্বিত করেছে, তেমনিভাবে একটি জাতিকে তার অভিশপ্ত ও অত্যাচারিত জীবন থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে। তাঁর মত দেশপ্রেমিক, বিচক্ষণ ও বিশাল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন গণমানুষের নেতার জীবনের অজস্র সংগ্রামী ঘটনাপুঞ্জ তাঁকে শুধু উপমহাদেশের বরেণ্য নেতা নয়, বিশ্বনেতা হিসেবে পরিচিত করে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেই ঘোষণা দিলেন, ‘আজ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম পূর্ব পাকিস্তানের বদলে শুধু বাংলাদেশ হবে।’ মূলতঃ সেদিন থেকেই শুরু হল বাঙালির স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার দুর্দমনীয় পথচলা।